শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ কী

সংকট সামাল দিতে দিন কয়েক আগে রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে
ছবি: শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের দপ্তর

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়, এমনটা হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র? সম্প্রতি ঠিক তা-ই ঘটেছে শ্রীলঙ্কায়। দেশটি নিজেদের ঋণখেলাপি ঘোষণা করে। এ পরিস্থিতির পেছনের কারণটা সবার জানা।

করোনা মহামারির অভিঘাত, পর্যটনশিল্প-রেমিট্যান্স-প্রবাহে ধসসহ নানা কারণে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি। রিজার্ভ সংকটে শ্রীলঙ্কার আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। দেশটিতে দেখা দেয় খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন সংকট। নিত্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি শ্রীলঙ্কার জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

তুমুল জনরোষে পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহকে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এ পদক্ষেপেও দেশটিতে থামেনি বিক্ষোভ।

সংকট নিরসনে শ্রীলঙ্কা সরকার অর্থ সহায়তা পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়েছে। সংস্থাটি শর্ত দিয়েছে, আগে দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। দ্রুত স্থিতিশীল সরকার গড়তে হবে। জনরোষ কমাতে হবে। তারপরই পাওয়া যাবে সহায়তা।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে (বাঁয়ে)

এখন প্রশ্ন হলো, শ্রীলঙ্কায় দ্রুত শান্তি-স্থিতিশীলতা ফেরানোর ভার কার কাঁধে বর্তাবে—প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে নাকি নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের? আপাতত এ প্রশ্নের উত্তর মেলানো বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বর্ষীয়ান গোতাবায়া ও রনিল দুজনই প্রভাবশালী ব্যক্তি। গোতাবায়া একসময় তাঁর দেশের জনগণের কাছে ‘নায়ক’ ছিলেন। এখন তিনি খলনায়কে পরিণত হয়েছেন। তাঁর পদত্যাগের দাবিতে দেশটির রাজপথ এখনো উত্তাল।

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, গোতাবায়া বিদায় নিতে যত সময় নেবেন, শ্রীলঙ্কায় শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরতে তত দেরি হবে। অন্যদিকে দেশের চরম সংকটময় মুহূর্তে ‘ত্রাতা’ হিসেবে ষষ্ঠবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল। তবে তাঁর ব্যাপারেও অনেকের আপত্তি আছে।

কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দেশ চালানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে রনিলের। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর হাত ধরে শ্রীলঙ্কায় শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরতে পারে। পাওয়া যেতে পারে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক সহায়তা। তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কাজটি তাঁর জন্য মোটেই সহজ হবে না। তাঁকে বড় ধরনের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি কতটা সক্ষম হন, তার ওপর নির্ভর করবে তাঁর সফলতা-ব্যর্থতা।

রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান রনিলের প্রধান চ্যালেঞ্জ জনগণের ‘ম্যান্ডেট’ না থাকা। এবারের আগে পাঁচবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তবে তিনি কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে।

শ্রীলঙ্কার আজকের পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে পরিবারকে দায়ী করছে দেশটির বিক্ষুব্ধ জনগণ। তাই তারা মাহিন্দার পর গোতাবায়ারও পদত্যাগ চাইছে। কিন্তু গোতাবায়ার পদ ছাড়ার কোনো ইচ্ছা আছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। উল্টো তিনি পদ ধরে রাখতে নানা কৌশল নিচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ অব্যাহত আছে

রনিল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা। সংসদে এ দলের একমাত্র প্রতিনিধি তিনি। ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের ক্যারিয়ার শেষ পর্যায়ে বলে মনে করা হচ্ছিল। সেখান থেকে তিনি নাটকীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেন।

রনিলকে অনেকে বাজার সংস্কারবাদী হিসেবে দেখে থাকেন। তাই বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহায়তা পেতে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবেন। পাশাপাশি তিনি একটি ঐকমত্যের প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবেন।

তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে রনিল কতটা সহায়তা পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিরোধীরা তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলছে, নিজের গদি টেকাতে রনিলকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। সংসদে একটিমাত্র আসন নিয়ে রনিল কোনোভাবেই প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে পারেন না। তাঁকে সংসদে দ্রুত সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে।

অভিযোগ আছে, রাজাপক্ষে পরিবারের ঘনিষ্ঠ রনিল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথের পর তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মাহিন্দার টুইট এ অভিযোগকে আরও জোরালো করে।

জানা গেছে, রনিলের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় গোতাবায়ার দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি) নেতারা যোগ দিচ্ছেন। এ সরকারে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বেশির ভাগ বিরোধী দল।

বিরোধীরা হুমকি দিয়েছে, আগামী সপ্তাহে গোতাবায়ার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হবে। এ প্রস্তাব পাস হলে রনিলের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন বলে মনে করেন না দেশটির ন্যাশনাল ফ্রিডম পার্টির নেতা উইমাল বিরাসেনা। তিনি বলেন, দেশের সংকটময় অবস্থার জন্য তাঁকেও জবাবদিহির মুখে পড়তে হতে পারে।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাঙ্গা জয়াসুরিয়া বিবিসিকে বলেন, রনিলকে প্রধানমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে আসলে আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। কারণ, সংকট থেকে উত্তরণে এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে, যাঁর জনসমর্থন নেই। এতে সাধারণ মানুষ আরও খেপে যেতে পারে।

একই মত শ্রীলঙ্কার আর্চবিশপ ম্যালকম রণজিতের। তিনি বলেন, দেশের জনগণ যাঁকে গ্রহণ করেনি, সমর্থন দেয়নি, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা উচিত নয়।

গোতাবায়া নিজের পদ রক্ষায় যা কিছুই করেন না কেন, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন সুতায় ঝুলছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, প্রেসিডেন্টের পদ থেকে গোতাবায়ার সরে যেতে বাধ্য হওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার। কেননা, তাঁর ভাই মাহিন্দার ক্ষমতা ছাড়ার পরও সরকারবিরোধী আন্দোলন থামেনি। গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে এখনো অবস্থান নিয়ে রেখেছেন বিক্ষোভকারীরা।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক পাকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু নিউজউইক সাময়িকীকে বলেন, গোতাবায়া যদি নিজ থেকে পদত্যাগ না করেন, তাহলে তাঁকে অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে বিকল্প একটাই—আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা।

বিশ্লেষক পাকিয়াসোথি সারাভানামুত্তুর মতে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য এখন শ্রীলঙ্কার সবার আগে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহায়তা। যিনি দ্রুত এ সহায়তা এনে দিতে পারবেন, তিনি দেশটির মানুষের কাছে নায়ক বিবেচিত হবেন। এ ক্ষেত্রে গোতাবায়ার চেয়ে রনিলের পথ তুলনামূলক মসৃণ। দেশটিতে এখন দ্রুত পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠন করতে হবে। আইএমএফ ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরীক্ষায় উতরাতে পারলে রনিলের পক্ষে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

শ্রীলঙ্কার আজকের পরিস্থিতির জন্য রাজাপক্ষে পরিবারকে দায়ী করছে দেশটির বিক্ষুব্ধ জনগণ। তাই তারা মাহিন্দার পর গোতাবায়ারও পদত্যাগ চাইছে। কিন্তু গোতাবায়ার পদ ছাড়ার কোনো ইচ্ছা আছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। উল্টো তিনি পদ ধরে রাখতে নানা কৌশল নিচ্ছেন।

নতুন প্রধানমন্ত্রীও চান না, গোতাবায়া পদ ছাড়ুক। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রনিলের এ মনোভাব স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, দোষারোপের রাজনীতি কোনো সুফল দেবে না। আগের সরকারের সব নীতি পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করবেন না।

ইতিবাচক ধারায় ফেরার আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন রনিল। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে রয়েছে, তাতে দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত কাটবে বলে মনে হয় না।

প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তাঁর পদ ধরে রাখার চেষ্টায় সফল হবেন কি না, নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হবেন কি না, গোতাবায়া-রনিলকে বিরোধীরা হটাতে পারবেন কি না, শ্রীলঙ্কার সংকট আরও ঘনীভূত হবে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সময়ই এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, নিউজউইক, রয়টার্স