বিশেষজ্ঞ অভিমত

শ্রীলঙ্কা–চীন সম্পর্কে আসবে বড় আঘাত

প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সুইমিং পুলে বিক্ষোভকারীদের গোসল
ছবি: বিবিসির সৌজন্য

ঘোরতর সংকটে শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সামনে শ্রীলঙ্কানদের কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এখনই আন্দাজ করা মুশকিল। তবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা চীনের প্রভাব কমতে পারে দেশটিতে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কলম্বোয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ‘বড় প্রভাব’ ফেলবে। তাঁরা এই পরিস্থিতিকে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্যও বার্তা বলে মনে করছেন।

গত শনিবার কলম্বোয় হাজারো বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়লে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সোমবার প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

শ্রীলঙ্কার যত বৈদেশিক ঋণ রয়েছে, তার ১০ শতাংশ বা তার কম চীন এবং জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। আন্তর্জাতিক বন্ডহোল্ডারদের কাছ থেকে বেশির ভাগ ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা।

গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে বিক্ষোভকারীদের হামলার পর তিনি বলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ একমত হয়েছে যে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে

চীনের সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেছেন, আর্থিক সংকট নিয়ে কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভের পর সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আঘাত হবে।

প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী রাজাপক্ষে পরিবারকে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হতো। যখন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, তখন চীনের অর্থায়নে বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তোলা হয় দেশটিতে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। বিতর্কিত ঋণের অংশ হিসেবে ৯৯ বছরের চুক্তির অধীনে একটি চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে সমুদ্রবন্দরটি ইজারা দেওয়া হয়েছিল।

লিন মিনওয়াং বলেন, ‘স্বল্প মেয়াদে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চীনের সম্পর্কে বড় প্রভাব পড়বে। কারণ, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বৃত্তে রাজাপক্ষে পরিবারের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন অসম্ভাব্য হবে।

দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লিন আরও বলেন, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ ঋণ এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে সৃষ্ট শ্রীলঙ্কার এ সংকট চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘সতর্ক বার্তা’। এসব বিনিয়োগকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন, যেসব দেশ জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, খাদ্যঘাটতি এবং ক্রমবর্ধমান মার্কিন সুদের জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

ওই বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে লিন আরও বলেন, ‘আমি একে উচিত শিক্ষা পাওয়া বলব না। তবে একে বলব সকর্তবার্তা। কারণ, বিদেশে বিনিয়োগ করার সময় স্থানীয় প্রশাসনের দক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিশেষ করে যখন সামগ্রিক আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনূকূলে নয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঋণের অনুপাত সাধারণত খুব বেশি।’

সাংহাইয়ের এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শ্রীলঙ্কায় চীনের যে বিনিয়োগ, তার জন্য কিছু লোকসান গুনতে হতে পারে।

চীন ও শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি নেতিবাচক ভাবার কারণ নেই। কারণ, ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কার আসলে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীনের মতো একটি দেশের প্রয়োজন।
লিন মিনওয়াং, চীনের সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ

শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারলে বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারেন বলে জল্পনা চলছে। সাজিথ ক্ষমতায় গেলে চীনের জন্য অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। কারণ, তিনি তাঁর আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী বলে মনে করা হয়।

লিন বলেন, চীন একটি দল বা অন্য পক্ষের দিকে ঝুঁকছে না। এই কারণেই শ্রীলঙ্কার আগের সরকারগুলো চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিল।

অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কা তার প্রতিবেশী ভারতের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যেমন জ্বালানি এবং ওষুধের জন্য ভারত হাত বাড়িয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কাকে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বেশি মূল্যের ঋণসুবিধা বাড়িয়েছে। তবে লিন বলেছেন, ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক নিয়ে তাঁর সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, চীন ও শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি নেতিবাচক ভাবার কারণ নেই। কারণ, ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কার আসলে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীনের মতো একটি দেশের প্রয়োজন।

শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য কৌশলগত অবস্থানে আছে দেশটি। বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধ, ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলা থেকে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুরস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাকালে করোনা মহামারি দেশটির পর্যটনশিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশটির মোট অর্থনীতির ১০–১৫ শতাংশ নির্ভর করে পর্যটনের ওপর। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কারণ, শ্রীলঙ্কার তৃতীয় বৃহত্তম চায়ের বাজার রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে ও সুইফট সিস্টেম বন্ধ থাকায় রাশিয়ার কাছ থেকে অর্থ পাচ্ছে না শ্রীলঙ্কা। এ পরিস্থিতিতে বেইজিংয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছে কলম্বো। এর মধ্যে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার চেয়েছে ঋণ পরিশোধের জন্য ও ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার চীনা পণ্য কেনার জন্য ঋণসুবিধা রয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে আলোচনার পরও এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

শ্রীলঙ্কার যত বৈদেশিক ঋণ রয়েছে, তার ১০ শতাংশ বা তার কম চীন এবং জাপানের কাছ থেকে নেওয়া। আন্তর্জাতিক বন্ডহোল্ডারদের কাছ থেকে বেশির ভাগ ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা।