শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম জাপান। কিন্তু লিঙ্গসমতায় দেশটি এখনো অনেক পিছিয়ে। লিঙ্গসমতায় বিশ্বের ১৫৬টি দেশের মধ্যে এ দেশের অবস্থান এখন ১২০তম।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আজ বুধবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লিঙ্গসমতা পরিস্থিতি নিয়ে বার্ষিক বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন–২০২১ প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনেই এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর লিঙ্গসমতায় জাপান এক ধাপ এগোলেও দেশটি এখনো তলানির দিকে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানের অবস্থান একেবারে নিচে। এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও জাপান অনেকটা পিছিয়ে।
এর আগে গত বছর ১৫৩টি দেশের মধ্যে লিঙ্গসমতায় জাপানের অবস্থান ছিল ১২১তম। এ বছর ১৫৬টি দেশের ওপর জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন অনুসারে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গসমতায় জাপান সবার নিচে। এ দেশের ওপরেই রয়েছে ইতালি। শিল্পোন্নত এ দেশের অবস্থান তালিকায় ৬৩ নম্বরে। এর থেকেই বোঝা যায়, অগ্রসর দেশগুলোর তুলনায় জাপান কতটা পিছিয়ে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে লিঙ্গসমতা অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়ার গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। অথচ গত বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে লিঙ্গসমতা অর্জনে বিশ্বের সময় লাগবে আনুমানিক ৯৯ বছর। আর এবারের প্রতিবেদন বলছে, ১৩৬ বছরের আগে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
এই মন্থর গতির কারণ হিসেবে করোনাভাইরাসের মহামারিকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারির কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে নারীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনাভাইরাস অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় শুরুতেই কর্মচ্যুত হতে হয়েছে খণ্ডকালীন শ্রমজীবীদের। এই তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি।
এদিকে লিঙ্গসমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়নে সাম্প্রতিক সময়ে জাপান বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও সার্বিক কোনো অগ্রগতি এখনো লক্ষণীয় হয়নি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ–সম্পর্কিত অতিসাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করছেন। তাঁদের মতে, এসব ঘটনাই জাপানকে লিঙ্গসমতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে দিচ্ছে। এসব কেলেঙ্কারির মধ্যে টোকিও অলিম্পিক আয়োজক কমিটির সাবেক প্রধানের নারীর প্রতি অবজ্ঞামূলক মন্তব্য এবং এর জের ধরে তাঁর পদত্যাগের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও জাপানের অবস্থান মোটেও ভালো নয়। লিঙ্গসমতার দিক থেকে এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে ফিলিপাইন। নতুন প্রতিবেদনে দেশটির অবস্থান ১৭তম। বাংলাদেশের অবস্থান এ তালিকায় ৬৫তম। অর্থাৎ, জাপানের নিকট প্রতিবেশী প্রায় সব দেশই লিঙ্গসমতার দিক থেকে দেশটিকে পেছনে ফেলেছে।
অবশ্য লিঙ্গসমতার সব সূচকে জাপান যে পিছিয়ে, তা কিন্তু নয়। তবে প্রধান দুটি সূচকে তেমন কোনো অগ্রগতি জাপান অর্জন করতে পারেনি। এই সূচক দুটি হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ। জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নারীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ১৮ শতাংশ এবং উচ্চকক্ষে ২৮ শতাংশ। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও নারীরা খুব একটা এগিয়ে নেই। অন্যদিকে জাপানের মন্ত্রিসভায় নারীর আনুপাতিক উপস্থিতি মাত্র ১০ শতাংশ।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এ বছরের প্রতিবেদনে এসব দৃষ্টান্ত তুলে ধরার পাশাপাশি আরও বলা হয়েছে, জাপানের ইতিহাসে কোনো নারীকে এখনো সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং সুযোগের ক্ষেত্রেও জাপান অনেকটাই পিছিয়ে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের মোট নারীর ৭২ শতাংশ শ্রমজীবী হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পদগুলোয় তাঁদের আনুপাতিক হার মাত্র ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে নারী-পুরুষের আয়ের ক্ষেত্রেও বেশ বড় বৈষম্য রয়েছে।
খণ্ডকালীন কর্মজীবীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার তাঁরাই হয়ে থাকেন। ফলে জাপানে নারীদের গড় আয় পুরুষের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ কম।
জাপানের নীতিনির্ধারকেরাও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের পিছিয়ে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ২০২১ সালের লিঙ্গসমতা প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর আজ সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জাপান সরকারের মুখপাত্র এবং মন্ত্রিসভার চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি কাৎসুনোবু কাতো বলেন, লিঙ্গসমতা অর্জনে জাপানের নেওয়া নানা রকম প্রচেষ্টার পরও অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে, লিঙ্গসমতা প্রতিবেদনে তা পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে জোরালো প্রচেষ্টা চালাতে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলে সরকার কাজ করবে।