জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে

লক্ষ্য অর্জন অসমাপ্ত রেখেই বিদায় নিচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী

২০১২ সালের ডিসেম্বরে শিনজো আবে দ্বিতীয়বারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময় কেউ ভাবেনি, তিনি এতটা দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করবেন। কারণ, এর আগে ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার এক বছর পূরণ না হতেই স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁকে সরে যেতে হয়েছিল। ফলে অনেকের ধারণ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত চিকিৎসা নেওয়া সত্ত্বেও খুব বেশি দিন আবে সরকারের হাল ধরে রাখতে পারবেন না। তবে সাধারণের সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে জাপানের টানা সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড গড়েছেন তিনি। কিন্তু সেই রেকর্ড গড়ার ঠিক চার দিন পর গতকাল শুক্রবার তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। এবারও সেই একই অসুখ, আলসারেটিভ কোলাইটিস। যার কারণে পদত্যাগ করতে হলো তাঁকে।

তবে এখন আর কেউ শিনজো আবেকে আগের সেই চোখে দেখছে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষিত লক্ষ্যের অনেকগুলোই তিনি পূরণ করতে পারেননি। এ সত্ত্বেও আবেকে সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

আবের সাফল্যের পেছনে আছে জাপানকে আরও বেশি উন্মুক্ত সমাজে পরিণত করা। দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা অভিবাসনের দুয়ার খুলে দিতে বেশ কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। এর বাইরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক উপস্থিতির কারণেও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অন্যান্য অগ্রসর অর্থনীতির দেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের পর্যায়ের। যদিও শেষ দিকে এসে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট জটিল হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের সঙ্গেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করেছিলেন তিনি।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বেলায় ঠিক উল্টো প্রবণতা দেখা গেছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন–জাপান সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এর কারণ আবের সঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঘনিষ্ঠতা এবং ওই নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর সখ্য। তবে দ্রুতই সেই অনিশ্চয়তা কেটে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ট্রাম্পের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হন আবে। জাপানকে অবশ্য এর জন্য বেশ কিছু মূল্য দিতে হয়েছে। বহুজাতিক বাণিজ্য চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এবং চীনের সঙ্গে ক্রমশ তৈরি হওয়া দূরত্ব হলো এর কিছু দৃষ্টান্ত।

আবের ব্যর্থতাও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাপানের অর্থনীতিকে স্থবির অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টায় তেমন অগ্রগতি অর্জন করেতে না পারা। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশের অর্থনীতিকে আবারও সজীব করে তুলতে তিনি ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্য অর্জন করবেন। আবের সেই লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে সরকারের তহবিল ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তাঁর সরকার দুই দফায় ভোগ্যপণ্য কর বাড়িয়েছে। এতে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এ কারণে ভোক্তা ব্যয় কমে গিয়ে ফল হয়েছে উল্টো।

জাপানের ঋণের বোঝা কমাতেও ব্যর্থ হয়েছে আবের সরকার। বরং জাপানের ঋণ অনেক বেড়েছে। ফলে ‘আবেনোমিক্স’ নাম নিয়ে যে অর্থনীতি আবের অনুসারীরা প্রবর্তন করেছিলেন, এর কার্যকারিতা জাপানে তেমন লক্ষ করা যায়নি। আর তাই শেষ দিকটায় আবের নিজেকেও ‘আবেনোমিক্সের’ উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকতে দেখা গেছে।

আবের আরেকটি ব্যর্থতা হচ্ছে জাপানের সংবিধান সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারা। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, নিজের মেয়াদকালে সংবিধান সংশোধন করে, বিশেষ করে শান্তির ধারা নামে পরিচিত নবম ধারার প্রতিবন্ধকতা দূর করে জাপানকে ‘স্বাভাবিক একটি রাষ্ট্রে’ পরিণত করবেন তিনি। নবম ধারায় জাপানের আবারও সমরায়ণ প্রতিহত করতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিদেশে শান্তি রক্ষাসহ অন্যান্য মিশনে যোগ দেওয়া জাপানের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সংবিধান সংশোধনের সেই অধরাই রয়ে গেল আবের জন্য।

সসাফল্য–ব্যর্থতার এ রকম মিশ্রণ সত্ত্বেও টানা ২ হাজার ৮০০ দিনের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন হচ্ছে জাপানের রাজনীতিতে নতুন এক মাইলফলক। আবে এটা অর্জন করতে পেরেছেন দলের ভেতরে নিজের কারিশমার গুণে, ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতাদের মধ্যে যাঁর অভাব স্পষ্টতই বিরাজমান। বিরামহীনভাবে তিনি কাজ করে গেছেন এবং আট বছরে শতাধিক দেশে সরকারি সফর করেছেন। কিন্তু এই সবকিছুই তাঁর পুরোনো অসুখকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। চিকিৎসকেরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, শরীরের প্রতি যত্নশীল হতে। আর তাই করোনা মহামারির কঠিন সময়েও নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।

শিনজো আবে সফল, না ব্যর্থ—তা নিয়ে আলোচনা চলছে, চলবে। তবে জাপানের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।