এক মাস আগে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঘোষণা করেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে বেইজিং নতুন করে যে জোরালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার কোনো সীমা নেই। তখন বেইজিংয়ে পুতিনের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের মুখোমুখি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠক শেষে তাঁরা যৌথভাবে একটি সমঝোতাপত্র তৈরি করেছিলেন। এরপর দুজনে মিলে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসে উপস্থিত হন। অলিম্পিক আসর শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরই ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
চীনা সরকার এ হামলা নিয়ে নিন্দাও যেমন জানায়নি, তেমনি আবার সরাসরি এর পক্ষেও অবস্থান নেয়নি। চীন বরাবরই বলে আসছে, অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করে না। এটি তাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি প্রাধান্যের বিষয়। সরাসরি কারও পক্ষ না নেওয়ায় রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে অবশ্য চমকে গেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, চীন কি তাহলে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনছে কি না। ইউক্রেনে রুশ হামলা ঠেকাতে চীনের এমন ভূমিকার সম্ভাব্য কারণ তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সপ্তাহের শুরুর দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি আভাস দিয়েছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্রবিরতি প্রশ্নে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত আছেন তাঁরা। তখন চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওয়াং। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, কূটনীতির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসানে সব রকমের প্রচেষ্টা চালাতে প্রস্তুত আছে চীন।
সামরিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেছে চীন সরকার। এর কারণে বেসামরিক নাগরিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উল্লেখ করে অত্যন্ত উদ্বেগ জানায় তারা। এ ছাড়া আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে চীন। রুশ অভিযানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাসের জন্য অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে অংশ না নেওয়া ৩৪ দেশের একটি এটি। চীনের এমন ভূমিকায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকে চমকে গেছেন। কারণ, তাঁরা ধারণা করেছিলেন, রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোট দেবে চীন।
চীন কী তাহলে তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনছে?
চীনের সাম্প্রতিক ভূমিকার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, দেশটি রাশিয়ার বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগকে স্বীকৃতি প্রদান এবং একই সঙ্গে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়।
চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেইজিং ও মস্কোর মধ্যকার সম্পর্ক গভীর করার ঘোষণা দিয়ে ৫ হাজার শব্দের নথিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই নথি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ন্যাটোর বিস্তারের বিরোধিতার প্রশ্নটিই চীন ও রাশিয়াকে একত্র করেছে। যদিও ওই সমঝোতাপত্রে দুই পক্ষের সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি চীন ও রাশিয়ার যৌথভাবে তৈরি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, যার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
রাশিয়া ও ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য চীন কেন এত দ্রুত সমর্থন ব্যক্ত করেছে, কিংবা নিন্দা জানাতে চাইছে না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তাইওয়ান প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপ অঞ্চলটিকে রগ প্রদেশ হিসেবে দেখে থাকে বেইজিং। একে চীনের অংশ হিসেবেই দেখেন সি চিন পিং। তিনি যদি সামরিক প্রভাব খাটিয়ে অঞ্চলটিকে দখলে নিতে চান, তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্ররা একই রকম কিংবা তার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। চীনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ, নিষেধাজ্ঞা প্রদান কিংবা সাংস্কৃতিক আয়োজন থেকে দেশটিকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
যদিও তাইওয়ান আর ইউক্রেন এক নয়। সবকিছু বাদ দিলেও, অন্তত বৈধতার মর্যাদায় দুই জায়গার অবস্থান ভিন্ন। এরপরও রাশিয়ার ‘বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগ’কে স্বীকৃতি জানিয়ে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের মূল নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যে চীন নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনের নেতা সি চিন পিং হয়তো চাইছেন, ভবিষ্যতে তাইওয়ানে অভিযান চালালে তিনি যেন একে ন্যায্য বলে দাবি করতে পারেন। একই সঙ্গে রাশিয়ার কাছ থেকেও সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি।
সি চিন পিং ও পুতিনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কও রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁরা প্রায় ৪০ বার একান্ত বৈঠক করেছেন। গত মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক গেমসেও উপস্থিত ছিলেন পুতিন। পুতিনই সবচেয়ে প্রভাবশালী বিশ্বনেতা, যিনি করোনা মহামারির পর চীন সফর করেছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে পুতিন ও চিন পিংকে স্বৈরশাসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এ দুই নেতাই নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার এবং নিজেদের দেশ ও জনগণের মধ্যে যথাযথ সম্মানবোধ তৈরির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।
সি চিন পিং এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে বিশাল অর্থনীতির দেশ চীন অনেক বেশি স্বনির্ভর থাকবে।
তবে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে গড়ে ওঠা ‘সীমাহীন’ সম্পর্কের মানে এ নয় যে যুক্তরাষ্ট্র, এর মিত্রদেশ এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব শৃঙ্খলার বিপক্ষে জোট গড়ে তোলা। সবকিছুর পরও এ বিশ্ব শৃঙ্খলা রক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগের চেয়ে বেশি করে ভূমিকা রাখতে চেয়েছে চীন।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতিও একটি বিবেচ্য বিষয়। এটি নির্বাচনের রাজনীতি নয়, বরং এটি যুদ্ধরত দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার রাজনীতি। চীনের জনগণ কী দেখবে, কতটুকু পড়তে পারবে, তা নিয়ে সরকারিভাবে সেন্সরশিপ আরোপ করা আছে। অথচ এ দেশেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা বিস্তারিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে। রাশিয়া প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান নিয়ে বেইজিংয়ের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সি চিন পিং ও তাঁর আশপাশের জ্যেষ্ঠ নেতারা হয়তো বুঝে গেছেন যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমারেখা থাকা উচিত এবং সেখান থেকে ফিরে আসা প্রয়োজন। অথবা সামনে এগিয়ে মস্কোর সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের চেষ্টা করা প্রয়োজন। এটি সেই ভূমিকা, যা পালন করতে প্রস্তুত থাকার কথা ইউক্রেনকে বলেছিল বেইজিং। যদিও তেমন ভূমিকা শুরুর ইঙ্গিত এখনো দেখা যায়নি।