শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে (ডানে) এবং তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে (ডানে) এবং তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে

রাজাপক্ষেদের রাজত্বের শুরু যেভাবে

শ্রীলঙ্কার সরকারে কিছুদিন আগেও ছিল রাজাপক্ষেদের দাপট। দক্ষিণের হামবানটোটা এলাকা থেকে রাজনীতিতে উত্থান ঘটা রাজাপক্ষের পরিবার কিছুদিন আগপর্যন্তও মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করেছিল। বিক্ষোভের মুখে ৩ এপ্রিল রাতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য পদত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে নমাল রাজাপক্ষেও রয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবারের উত্থান নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। রাজাপক্ষে পরিবারের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্ম শ্রীলঙ্কার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন দখলে রেখেছে। এ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের গোতাবায়া রাজাপক্ষে এখন দেশটির প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তাঁদের দুই ভাই চামাল ও বাসিল রাজাপক্ষেও তৃতীয় প্রজন্মের। মাহিন্দার দুই ছেলে নামাল ও ইয়োশিথা রাজাপক্ষে এবং চামাল রাজাপক্ষের ছেলে শশীন্দ্র রাজাপক্ষে পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম। তাঁরাও মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখলে রেখেছিলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোনো দেশের শাসনকাঠামোয় এক পরিবারের এতটা আধিপত্য হয়তো নেই। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে মাহিন্দা রাজাপক্ষে যখন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, তখন সরকারের শীর্ষস্থানীয় ৪০টিরও বেশি পদে ছিলেন রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যরা। নির্বাচনে পরাজয়ের পর রাজাপক্ষে পরিবারের অনেকে আর্থিক জালিয়াতি নিয়ে তদন্তের মুখেও পড়েছিলেন। বাসিল রাজাপক্ষে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বাসিল রাজাপক্ষে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী এবং বড় মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গোতাবায়া ও মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভাতেও রাজাপক্ষে পরিবারের ১১ সদস্য ছিলেন। শুধু দেশটির মন্ত্রিসভাই নয়, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও রাজাপক্ষে পরিবারের দখলে। ওই পরিবার থেকে অন্তত একজন কূটনীতিক হিসেবে লস অ্যাঞ্জেলেসে কনসাল জেনারেলের দায়িত্বে আছেন।

যেভাবে শুরু

শ্রীলঙ্কার প্রথম পার্লামেন্টে রাজাপক্ষে ছিলেন দুজন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস আগেই পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। প্রথম পার্লামেন্টে যে দুজন রাজাপক্ষে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাবা ডন আলউইন রাজাপক্ষে। তিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএফএলপি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দুবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তখন আরেক প্রতিষ্ঠাতা অক্সফোর্ড-স্নাতক এস ওয়াই আর ডি বন্দরনায়েকের হাতেই ছিল দলের নিয়ন্ত্রণ। বন্দরনায়েকের জন্ম শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উপকণ্ঠে। ১৯৫৯ সালে তাঁকে হত্যা করা হলে তাঁর স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক দায়িত্বে আসেন।
মাহিন্দা ও গোতাবায়ার রাজত্ব

১৯৯৪ সালে শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছে থেকে এসএফএলপির নেতৃত্ব যখন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার হাতে গেল, তত দিনে রাজনীতিতে দুই দশক পার করেছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কুমারাতুঙ্গা দুই দফায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দুবারই তাঁর মন্ত্রিসভায় ছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তবে মন্ত্রিসভাতে থেকেও কুমারাতুঙ্গার নেতৃত্বকে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ তিনি জানাতে পারেননি। বড় ভাই চামাল ও চাচাতো বোন নিরুপমার মতো রাজাপক্ষে পরিবারের অন্যরাও রাজনীতিতে ছিলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোনো দেশের শাসনকাঠামোয় একটি পরিবারের এতটা আধিপত্য হয়তো নেই

২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন কুমারাতুঙ্গা। এরপর রাজনীতি থেকে তিনি অবসরে যান। ২০০৫ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন মাহিন্দা। ছোট ভাই ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব। গোতাবায়া সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তামিল বিদ্রোহীদের (এলটিটিই) পরাস্ত করার ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধ পরিকর। হাজারো সংখ্যালঘু তামিলকে হত্যা ও গুম করার ক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল তাঁর। ২০০৯ সালের পর রাজাপক্ষে পরিবারকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

সামরিক কায়দায় শ্রীলঙ্কা শাসন করতে শুরু করেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। পরিবারের সদস্যদের সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান মাহিন্দা রাজাপক্ষে। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষেরাই রাজা হয়ে ওঠেন। একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগে শুরু হয় দুর্নীতি। সে সময় দ্য সানডে লিডার পত্রিকার সম্পাদক লসানথা বিক্রমাতুঙ্গা হত্যার শিকার হন। এরপর মতপ্রকাশের জন্য সাংবাদিকেরাও ভীত হয়ে পড়েন।

মাহিন্দার পরাজয়

রাজাপক্ষে ভাইয়েরা চীনের দিকে হেলে পড়তে শুরু করেন। অবশ্য শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সময় থেকেই বেইজিং ছিল কলম্বোর বন্ধু। রাজাপক্ষেদের এ অবস্থান দেখে শ্রীলঙ্কার অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় চীন। ২০১১ সালে হামবানটোটা বন্দর উদ্বোধন করা হয়। চীনের উদ্যোগে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীন বিভিন্ন দেশে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সড়ক ও বন্দর। এই বন্দর ছিল তারই অংশ।

বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে চীনের কাছে একের পর এক ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা। একপর্যায়ে ঋণ শোধ করতে না পেরে হামবানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয় চীনকে। দিন যত যায় ঋণের ভার বাড়তে থাকে। দেশের অর্থনীতি ঋণনির্ভর হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্টে নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হেরে যান। এরপর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে এসএলএফপি পার্লামেন্ট নির্বাচনে হারলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতেও ব্যর্থ হন।

প্রত্যাবর্তন

২০১৮ সালে স্থানীয় নির্বাচনে মাহিন্দা আবার দৃশ্যপটে আসেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষে আবার ক্ষমতায় ফিরবেন এমন শঙ্কা থেকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন। অতীতে যার অধীন ছিলেন, সেই মাহিন্দাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। তবে নতুন করে গঠিত এই সরকার বেশি দিন টিকতে পারেনি। রনিল ফের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে কয়েক মাস পরই পদত্যাগ করেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন মাহিন্দা।

২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এরপর ২০২০ সালের মাঝামাঝি হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় পান মাহিন্দা। তবে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী মিলে রাজাপক্ষে ভাইদের নিয়ে গঠিত সরকার শ্রীলঙ্কার চলমান ভয়াবহ আর্থিক–সংকট সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে এখন ভুগতে হচ্ছে তাদের।