রাজনীতি। কারও কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি, কারও কাছে জনগণের সেবা করার সুযোগ। রাজনীতিতে নেমে কেউ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হন, কেউবা মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন। কেউ কেউ বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই।’ এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ যেন এই ‘কেউ কেউ’-এর দলে। মাহাথিরের সঙ্গে এই দলে আছেন তাঁরই ‘শিষ্য’ আনোয়ার ইব্রাহিমও!
মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে কয়েক মাস আগে ফিরেছে মাহাথির (৯৩) যুগ। সবকিছু ঠিক থাকলে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে আসছেন আনোয়ার ইব্রাহিমও (৭১)। মাহাথির-আনোয়ারের অম্লমধুর সম্পর্ক আধুনিক মালয়েশিয়ার ইতিহাসের এক অধ্যায়।
প্রথমবার ১৯৮১ সালের জুলাইয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন মাহাথির। এরপর টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আনোয়ার। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে তাঁকে উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন মাহাথির। বাক্স্বাধীনতা হরণ, বিরুদ্ধমত দমন, বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা সমালোচনা সত্ত্বেও মাহাথির-আনোয়ার জুটি আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার পথে কাজ করে যাচ্ছিলেন। দুজনের সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, মাহাথিরের পর তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন আনোয়ার।
তবে গোলমাল বাধে ১৯৯৮ সালে। মাহাথির উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন আনোয়ারকে। ওই সময়ে চলা আর্থিক মন্দা মোকাবিলা নিয়ে মতপার্থক্য ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জের ধরে আনোয়ারকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে মামলা হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তারও হন তিনি। যদিও এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছিলেন আনোয়ার।
মাহাথিরের বিরুদ্ধে একটি কথা বেশ প্রচলিত—কেউ কখনো তাঁকে কোনো দিক থেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেই ব্যক্তিকে ফেলে দেন তিনি। হয়তো আনোয়ারের ক্ষেত্রেও মাহাথিরের সেই অহংবোধ কাজ করছিল। ১৯৯৯ সালে আনোয়ারকে ছয় বছরের সাজা দেন আদালত। একই সঙ্গে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতিক পদে তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সালে আরেক মামলায় আনোয়ারকে আরও নয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ে আদালত বলেন, আগের ছয় বছরের সাজা শেষ হওয়ার পর এই নয় বছরের সাজার মেয়াদ গণনা শুরু হবে। আদালতের এই রায়ে মাহাথিরের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
টানা ২২ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন মাহাথির। তবে তাঁর দল ও জোট ক্ষমতায় থাকে। মাহাথির ক্ষমতা ছাড়ার কিছুদিন পরই উচ্চ আদালতের রায়ে মুক্তি পান আনোয়ার। দ্রুত তিনি মালয়েশিয়ার বিরোধী দলের কার্যত প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ২০০৮ সালে আনোয়ারের নেতৃত্বেই পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে ভালো ফল করে বিরোধী জোট। কিন্তু তিনি এবার পড়লেন মাহাথিরেরই দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রোষানলে। ২০১০ সালে তাঁকে আবার অভিযুক্ত করা হয়। তবে ২০১২ সালে আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন বিরোধী জোটের সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন আনোয়ার। কিন্তু ২০১৫ সালে তাঁকে অভিযুক্ত করে আবারও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। তার মানে ২০২০ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে নিষিদ্ধ হন তিনি।
এরপরই আবার দৃশ্যপটে হাজির মাহাথির মোহাম্মদ। ২০১৬ সালে নাটকীয়ভাবে এক আদালতকক্ষে মাহাথির-আনোয়ারের সাক্ষাতের পর ঘোষণা আসে—তাঁরা নাজিব রাজাকের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবেন। কিন্তু নিজের দল ও জোটের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেন আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিলেন মাহাথির? এর প্রথম কারণ হলো দুর্নীতি। নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে সরকার পরিচালিত ওয়ানএমডিবি কোম্পানির বিলিয়ন ডলার অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ ওঠে। তবে কেউ কেউ এ ক্ষেত্রেও মাহথিরের সেই অহংবোধের বিষয়টিই টেনে আনেন—‘কেউ কখনো তাঁকে কোনো দিক থেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেই ব্যক্তিকে ফেলে দেওয়া।’
এরপর তো ইতিহাস গড়লেন মাহাথির। নিজের একসময়ের দল ও জোটের বিরুদ্ধে নির্বাচনের মাঠে নামলেন। গত মে মাসে ৯২ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মালয়েশিয়ার দায়িত্ব নিলেন। একই সঙ্গে ১৯৫৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর মালয়েশিয়ায় এই প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় কোনো জোট ক্ষমতায় এল। মাহাথির ক্ষমতায় আসার পরপরই মুক্তি পান আনোয়ার ইব্রাহিম। এরপর উপনির্বাচনে জিতে পার্লামেন্টে ঢুকেছেন তিনি। এখন আনোয়ারের অপেক্ষা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। মাহাথির অবশ্য অঙ্গীকার করেছেন, দুই বছর পর আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াবেন তিনি। এখন মাহাথির তাঁর ওই অঙ্গীকার পূরণ করবেন নাকি আবারও সেই অহংবোধ জেগে ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মাহাথির যে আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিজের ডেপুটি করেছিলেন তাঁকেই উপপ্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ছুড়ে ফেলে কারাগারে পাঠালেন। ১৮ বছর পর তাঁর সঙ্গে দেখা করে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করলেন। নির্বাচনে জিতে আনোয়ারের স্ত্রীকে মালয়েশিয়ার ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ দিলেন। সবকিছু ঠিক থাকলে দুই বছর পর আনোয়ারের হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব তুলে দিয়ে সরে যাবেন মাহাথির। আনোয়ারও তিক্ততা ভুলে তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরুর’ ওপর আস্থা রাখছেন। সত্যিই মাহাথির-আনোয়ার জুটিকে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই’ কথাটির আদর্শ বিজ্ঞাপনই বলা যায়!