নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কা। তবে এ সংকট শুধু অর্থনীতিতে আটকে নেই। খাদ্যপণ্য থেকে জ্বালানির সংকটে ক্ষুব্ধ মানুষ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছেন। জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলেও স্থিতাবস্থা আসেনি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যমুক্ত সরকারের দাবিতে এখনো উত্তাল রাজপথ। দেশটিতে আজকের যে সংকট, তার শুরু থেকে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে।
শ্রীলঙ্কায় লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট এবং অসহনীয় বিদ্যুৎ ঘাটতির জেরে সৃষ্ট রাজপথের আন্দোলন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে অন্য মন্ত্রীদের নিয়ে এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে নতুন নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধীরা। রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি ও বিক্ষিপ্ত সহিংসতা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটিয়ে ওঠা ও এরই মধ্যে কোডিভ–১৯–এর কারণে ব্যাপকভাবে ধাক্কা খাওয়া পর্যটননির্ভর অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের মতো বিষয় জটিল করে তুলেছে।
২০১৯ সালের শেষ দিকে রাজাপক্ষে জনতুষ্টিমূলক কর কর্তনের পদক্ষেপ নেন। ফলে কোভিড মহামারির জেরে অর্থনীতিতে জোর ধাক্কা লাগার মাস কয়েক আগেই সরকারের রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও (প্রবাসী আয়) ভাটা পড়ে। ইতিমধ্যে করোনা মহামারি শুরুর পর প্রবাসীদের অনেকে চাকরিও খোয়ান।
বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খেতে থাকে শ্রীলঙ্কা। এই ঋণের বড় অংশই ছিল উচ্চাভিলাষী অবকাঠামাগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ। এমনকি ভারতের মতো প্রতিবেশীদের কাছেও দেনাদার হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হতে থাকে সরকার। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় ২০২১ সালে রাজাপক্ষের জৈব সারভিত্তিক চাষের সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কৃষেকেরা। রাতারাতি এমন পদক্ষেপে দেখা যায়, চা ও ধান উৎপাদনে ধস নেমেছে।
শ্রীলঙ্কার ৮১ বিলিয়ন (৮ হাজার ১০০ কোটি) ডলারের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর আঁচ লেগেছে শ্রীলঙ্কায়ও। সব মিলিয়ে দেশটির প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে।
গত কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় এখন মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ। চলতি বছরের এপ্রিলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ। মার্চের তুলনায় এই বৃদ্ধি প্রায় ১৯ শতাংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটায় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানিতে লাগাম টেনে ধরে। কিন্তু মাত্র ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার নিয়ে চলতি বছরের মধ্যে ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলারের ঋণ পরিশোধ করে অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য লড়াই–ই বটে। ৯ মে মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগও সরকারের জন্য এমন অবস্থা তৈরি করেনি যে তারা খাদ্য ও জ্বালানি তেল কিনতে জরুরি ভিত্তিতে তহবিল পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
শ্রীলঙ্কায় লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট এবং অসহনীয় বিদ্যুৎ ঘাটতির জেরে সৃষ্ট রাজপথের আন্দোলন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
তিন বছর আগে যাঁরা রাজাপক্ষেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন দিন দিন তাঁদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। গত মার্চ থেকে বিদ্যুৎ–সংকটে গৃহস্থালির কাজকর্ম ও ব্যবসা–বাণিজ্য চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। জ্বালানি তেলের জন্য পাম্প স্টেশনগুলোতে লম্বা লাইন তৈরি হতে থাকে। নিত্যদিনের খাদ্যপণ্যের সংকট তৈরি হয়। যা–ও বা পাওয়া যাচ্ছে, তা তুলনামূলকভাবে অনেক ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এ অবস্থায় রাজাপক্ষের বিরোধীরা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কলম্বোয় অবস্থান কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এরই মধ্যে তা কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।
৬ মে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ফলে জনগণকে গারদে পোরাসহ যে কারও সম্পদ জব্দের ক্ষমতা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুই মাসের মধ্যে এটি ছিল দ্বিতীয় দফায় জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা। দেশজুড়ে জারি করা কারফিউর মধ্যে রাজধানী কলম্বোয় সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামানো হয় বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়। এ অবস্থায় কিছু জায়গায় বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে।
সহিংসতায় বেশ কিছু মানুষ আহত হন। ২০২০ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া রাজাপক্ষে এই সহিংসতার নিন্দা জানান ও সংকটের সুরাহায় সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে বিরোধীদের সংসদে বসার আহ্বান জানান। তবে এর বিপরীতে বিরোধী দলগুলোর নেতারা নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করছেন; আহ্বান জানাচ্ছেন সংবিধানের সংশোধনী বাতিলের।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটায় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানিতে লাগাম টেনে ধরে। কিন্তু ২০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার নিয়ে চলতি বছরের মধ্যে ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করে অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য লড়াই-ই বটে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে সংঘাত–সহিংসতায় নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। সিংহলিদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী লিবারেশন টাইগার্স অব তালিম ইলমের (এলটিটিই) মধ্যকার লড়াই চলে কয়েক দশক ধরে। এই গৃহযুদ্ধে প্রাণহানি হয় এক লাখের বেশি মানুষের। ২০০৯ সালে দীর্ঘ এই লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয় সরকার। তবে উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জোরালো অভিযোগ আছে। যাহোক, এরপর ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে বোমা হামলার আগপর্যন্ত দেশটিতে কোনো ধরনের অশান্তি সেভাবে দানা বাঁধেনি। আত্মঘাতী এই বোমা হামলায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হন। সরকার এ জন্য অনেকটাই অপরিচিত একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করে। এর কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে ভোট দেন জনগণ। সাবেক সেনা কর্মকর্তা রাজাপক্ষেকে অনেকে গৃহযুদ্ধের সময়কার নায়ক হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীন। তবে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও মন্ত্রিসভায় থাকা তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা বেইজিংয়ের দিকেই ঝুঁকে পড়েন।
নীতিনির্ধারকেরা সুদ পরিশোধের ব্যাপারে তৎপর হন এবং সহযোগিতা পেতে ভারতের দিকেও হাত বাড়ান। এরই মধ্যে ১২ এপ্রিল শ্রীলঙ্কা নিজের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে তার ঋণদাতাদের সতর্ক ও কিছু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কিস্তি স্থগিত করে।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, সহায়তার জন্য তহবিল পেতে আইএমএফের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা শুরু করা হবে। তবে মে মাসের প্রথমার্ধে তখনকার অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি পার্লামেন্টে বলেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে কমবেশি দুই বছর লাগতে পারে। আইএমএফের প্রকল্প শুরু হতে ছয় মাস পর্যন্ত লাগতে পারে বলেও জানান তিনি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: হাসান ইমাম