মোহাম্মদ বিন সালমানের খুঁটি নড়ে উঠেছে

গতকাল সোমবার রিয়াদে সুরা কাউন্সিলের বৈঠকে অংশ নেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি বাদশাহর দরবারের সৌজন্যে ছবিটি প্রকাশ করেছে রয়টার্স।
গতকাল সোমবার রিয়াদে সুরা কাউন্সিলের বৈঠকে অংশ নেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি বাদশাহর দরবারের সৌজন্যে ছবিটি প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

বাবার প্রিয় পুত্র হিসেবে সিংহাসনে আরোহণে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হয়েছিলেন ক্রাউন প্রিন্স। সাধারণত, ক্রাউন প্রিন্সই পরবর্তী শাসক হন। কিন্তু সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় ক্রমেই মিলিয়ে যেতে বসেছে তাঁর সে আশা। রাজপরিবারেরই কয়েকজন সদস্য এই ইস্যুকে সামনে এনে মোহাম্মদ বিন সালমানের পরবর্তী বাদশা হওয়ার সম্ভাবনায় বাদ সাধছেন। বাদশাহর দরবারের ঘনিষ্ঠ তিনজন–সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

পশ্চিমা বিশ্বে ‘এমবিএস’ বলে পরিচিত ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে যুবরাজ মোহম্মদ বাবার মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন—এটাই ছিল সহজ হিসাব–নিকাশ।

সূত্রমতে, শাসক আল সৌদ পরিবারের বেশ কয়েকজন যুবরাজ এবং যুবরাজ মোহাম্মদের চাচাতো ভাইয়েরা উত্তরাধিকারের সারিতে পরিবর্তন চান। তবে তাঁরা এটাও জানেন, ৮২ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান বেঁচে থাকতে এটা সম্ভব না। প্রিয় পুত্র যুবরাজ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বাদশাহর যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা সম্ভাব্য নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে। বাদশাহর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র জীবিত আপন ভাই ৭৬ বছর বয়সী যুবরাজ আহমেদ বিন আবদুলাজিজ সিংহাসনে আরোহণ করতে পারেন বলে সেই সব আলোচনায় উঠে আসছে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, যুবরাজ আহমেদের ব্যাপারে পরিবারের অন্য সদস্য, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যন্ত্র ও কিছু পশ্চিমা শক্তি সমর্থন দিতে পারে।

আড়াই মাস বিদেশে থাকার পর অক্টোবরে দেশে ফিরেছেন যুবরাজ আহমেদ। তাঁর সফরের সময় লন্ডনে তাঁর বাসার সামনে আল সৌদ রাজবংশের পতন চেয়ে বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় তিনি সৌদি নেতৃত্বের সমালোচনা করেছিলেন বলে জানা গেছে।

দুটি সূত্র জানিয়েছে, রাজপরিবারের ৩৪ জন জ্যেষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে গঠিত অ্যালেজিয়ান্স কাউন্সিলের মাত্র যে তিনজন গত বছর যুবরাজ মোহাম্মদের ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের একজন আহমেদ। সিংহাসনের জন্য ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার মনোনয়নের জন্য গঠন করা হয় এই অ্যালেজিয়ান্স কাউন্সিল।

এই উত্তরাধিকার ইস্যুতে যুবরাজ আহমেদ বা তাঁর কোনো প্রতিনিধির বক্তব্য নিতে পারেনি রয়টার্স। রিয়াদের কর্মকর্তারা রয়টার্সের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেননি।

হাউস অব সৌদে শত শত যুবরাজ রয়েছেন। ইউরোপের রাজপরিবারের মতো সেখানে উত্তরাধিকার হিসেবে বাবার মৃত্যুর পর বড় ছেলে ক্ষমতাসীন হন না। রাজ্যের প্রথা অনুসারে, বাদশাহ ও পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা নেতৃত্বের জন্য যাঁকে যোগ্য মনে করেন, তাঁকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

বাদশাহ মারা গেলে বা শাসন করার মতো সক্ষমতা না থাকলে ৩৪ সদস্যের অ্যালেজিয়ান্স কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশ পরিচালিত হবে। সেখানে যুবরাজ মোহাম্মদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদশাহ হওয়ার সুযোগ নেই। সিংহাসনে আরোহণের জন্য তাঁর কাউন্সিলের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বাদশাহর ইচ্ছা অনুসারে, যুবরাজ মোহাম্মদকে ক্রাউন প্রিন্স করা হলেও বাবার মৃত্যুর পর তাঁকেই বাদশাহ করা হবে, বিষয়টি তা নয়।

সৌদি সূত্রমতে, শত শত বছর ধরে চলা আল সৌদি শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভগুলোকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ। পরিবার, ধর্মীয় নেতা, সম্প্রদায় ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারগুলোয় ভাঙন তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে পরিবারের ভেতরে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি

মার্কিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সৌদি উপদেষ্টাদের আভাস দিয়েছেন যে, সিংহাসনে আরোহণের ব্যাপারে তাঁরা যুবরাজ আহমেদকে সমর্থন দিতে পারেন। আহমেদ ৪০ বছর ধরে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই আলোচনার ব্যাপারে সরাসরি জানেন—এমন সূত্রগুলো জানিয়েছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের আস্থা রয়েছে যে আর্থসামাজিক যেসব পরিবর্তন এনেছেন এমবিএস, সেগুলোয় কোনো পরিবর্তন আনবেন না যুবরাজ আহমেদ, সামরিক অস্ত্র কেনাবেচার চুক্তি বহাল রাখবেন এবং পরিবারের একতা পুনরুদ্ধার করবেন।

একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, খাসোগি হত্যায় যুবরাজ মোহাম্মদকে দায়ী করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও সিনেটরদের ক্রমাগত চাপ সত্ত্বেও যুবরাজ মোহাম্মদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরিতে কোনো তাড়া নেই হোয়াইট হাউসের। গতকাল সোমবার রিয়াদে সুরা কাউন্সিলে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাদশাহর বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে হোয়াইট হাউস। বাদশাহ ছেলের পাশে রয়েছেন বোঝা গেলেও তিনি সৌদির বিচার বিভাগের প্রশংসা করা ছাড়া খাসোগি হত্যার ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার সিআইএর প্রতিবেদনকে ‘পূর্ণাঙ্গ নয়’ কিন্তু ‘সম্ভব’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, মঙ্গলবার (আজ) পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি হাতে পাবেন।

তবে সৌদি সূত্র জানিয়েছে, এমবিএসের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন চুপচাপ থাকা শুধু খাসোগি হত্যার ঘটনার তাঁর ভূমিকার কারণে নয়; বেশ কয়েক মাস আগে ক্রাউন প্রিন্স সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে রাশিয়া থেকে বিকল্প অস্ত্র কেনার বিষয়টিতে জোর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন জেনে যন্ত্রণায় রয়েছেন তাঁরা। রয়টার্স যাচাই করে দেখেছে, গত ১৫ মে এক চিঠিতে মন্ত্রণালয়কে এ–সংক্রান্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ। এ ব্যাপারে মন্তব্য চেয়ে রয়টার্সের অনুরোধে সাড়া দেয়নি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা রিয়াদের কর্মকর্তারা।

গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয়। যুবরাজ মোহাম্মদের নির্দেশে এই হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খাসোগি গত বছর স্বেচ্ছানির্বাসনে সৌদি আরব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। সেখানে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে সৌদি শাসকদের, বিশেষ করে যুবরাজ মোহাম্মদের সমালোচনা করে কলাম লিখতেন।