মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে

২০২০ সালের ৯ আগস্ট শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় মাহিন্দা রাজাপক্ষে
 ফাইল ছবি: রয়টার্স

সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তবে তাঁর পদত্যাগেও দেশটিতে শান্তি ফেরেনি। গতকাল সোমবার শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় সরকার–সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় একজন সংসদ সদস্যসহ অন্তত পাঁচজন নিহত এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। হাম্বানটোটায় রাজাপক্ষেদের পৈত্রিক বাড়ি ছাড়াও সাবেক তিন মন্ত্রী ও দুই সংসদ সদস্যের বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

করোনার ধাক্কার পাশাপাশি সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছে দেশটি। ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, চলছে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। এই পরিস্থিতিতে সরকার পতনের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে।

অচলাবস্থা নিরসনে গত শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে বলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া সম্পর্কে মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছোট ভাই। এক যুগ আগে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতাকামী তামিল টাইগারদের দমন করে দেশে রাজাপক্ষে পরিবারের আধিপত্য তৈরি করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সে সময় সাবেক সেনা কর্মকর্তা গোতাবায়াকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এনেছিলেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগুরু সিংহলিজ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দা রাজাপক্ষের। গতকাল দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার সমর্থককে বাসে করে রাজধানীতে আনেন তিনি। নিজের বাসভবনের কাছে এক সমাবেশে তাঁদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুসারীরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানো শুরু করেন।

শ্রীলঙ্কায় এমপি সনাথ নিশানথার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা

গত ৯ এপ্রিল থেকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন বিক্ষোভকারীরা। সরকার–সমর্থকেরা প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হন।

সরকারবিরোধী ব্যানার-প্ল্যাকার্ডে আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা। পরে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপরও হামলা চালান তাঁরা। এরপর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার সরকারবিরোধী রাস্তায় নেমে আসেন। সরকার–সমর্থকদের সঙ্গে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কলম্বোয় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। তাতেও কাজ না হলে শহরে কারফিউ জারি করা হয়। পরে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়।

এদিকে অমরাকীর্থি আথুকোরালা নামের ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্য কলম্বোর উপকণ্ঠের নিত্তামবুয়া এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সামনে পড়েন। বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়ির পথ রোধ করলে তিনি গুলিবর্ষণ করেন। এতে একজন নিহত এবং আরেকজন গুরুতর আহত হন। একপর্যায়ে কাছের একটি ভবনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন ওই সংসদ সদস্য। পরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। শ্রীলঙ্কার পুলিশ বলেছে, বিক্ষোভকারীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীর অপমানজনক বিদায়

মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগ সময়ের ব্যবধানে একই ব্যক্তির ভিন্ন দুই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার চিত্রকে সামনে এনেছে। বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটার এক সম্পদশালী পরিবারে বেড়ে ওঠেন মাহিন্দা।

আইনজীবী থেকে ১৯৭০ সালে কনিষ্ঠ আইনপ্রণেতা হিসেবে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে যান তিনি। ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এক বছরের মাথায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। সে সময় স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল এলমের (এলটিটিই) সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সরকারের শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। এর মধ্যে ২০০৬ সালে ছোট ভাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষাসচিব করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এরপর সরকারের দমন অভিযানের মুখে ২০০৯ সালে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এলটিটিই। সে সময় ৪০ হাজারের মতো বেসামরিক তামিলকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জাতিসংঘের তথ্য।

তামিলদের দমনে মাহিন্দা রাজাপক্ষের বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলেও অভিযোগ করেছে।

এলটিটিই দমনের পর মাহিন্দা রাজাপক্ষের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। ২০১০ সালে পুনর্নির্বাচিত হন তিনি। এই দফায় পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তাঁর দলের। এতে ভর করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবৃদ্ধির পাশাপাশি এক ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদের সীমাবদ্ধতা তুলে দেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৫ সালের ভোটে নিজেরই মন্ত্রিসভার সাবেক এক সদস্যের কাছে হেরে যান মাহিন্দা রাজাপক্ষে।

২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলায় আড়াই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ভর করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। পরের বছর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় গোতাবায়া রাজাপক্ষের দল। এরপর বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষের পথ ধরে একইভাবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। আরও কয়েকজন স্বজনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়ে নিজেদের পরিবারকে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর একটিতে পরিণত করেন তিনি।

এখন কী হবে

সংকট সমাধানে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কথা বলছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। গতকাল তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তিনি লিখেছেন, দেশকে বর্তমানের অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনতে সর্বদলীয় সরকার গঠনের পথ করে দেওয়ার জন্য পদত্যাগ করছেন।

তবে এখনো সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিতে রাজি হয়নি বিরোধী দলগুলো। প্রেসিডেন্টেরও পদত্যাগ দাবি করেছে তারা।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর অন্য মন্ত্রীরাও পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন বলে শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। দুই মন্ত্রী গতকালই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।