মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ শহর ইয়াঙ্গুনে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১
মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ শহর ইয়াঙ্গুনে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মিয়ানমারে সেনাশাসনের বছরপূর্তি: যেদিন যা ঘটেছিল

মিয়ানমারে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। জয় পায় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ তুলে অভ্যুত্থান করে সামরিক বাহিনী। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো জানায়, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এরপরের এক বছরের ঘটনাক্রম তুলে ধরা হলো।

১ ফেব্রুয়ারি: সেনাবাহিনী ভোরে অভিযান চালিয়ে অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে। সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়।

৩ ফেব্রুয়ারি: অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে মিয়ানমারে ৭০টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা কর্মবিরতিতে যান। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে অনেকে লাল রঙের ফিতা পরে আন্দোলনে অংশ নেন। এনএলডির দলীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে নথিপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করে নিয়ে যায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
অং সান সু চির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বলা হয়, সেনা কর্মকর্তারা সু চির বাসভবনে অভিযান চালিয়ে ছয়টি ওয়াকিটকি খুঁজে পেয়েছে। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এসব ওয়াকিটকি বেআইনিভাবে আমদানি করে অনুমতি না নিয়ে ব্যবহার করেছেন সু চি। করোনাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও হয় মামলা।

৪ ফেব্রুয়ারি: মিয়ানমারের মান্দালয় শহরে ব্যানার হাতে অভ্যুত্থানবিরোধী স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন শত শত বিক্ষোভকারী।

৬ ফেব্রুয়ারি: টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে দেয় জান্তা সরকার। এসব ব্যবহার করে তথ্য আদান–প্রদান করতেন বিক্ষোভকারীরা। ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয় জান্তা।

৭ ফেব্রুয়ারি: ২০০৭ সালের পর সেনাবিরোধী সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ শুরু হয় মিয়ানমার জুড়ে। ইন্টারনেট সংযোগ সচল করা হলেও সামাজিক মাধ্যম বন্ধই থাকে।

৯ ফেব্রুয়ারি: রাজধানী নেপিডোতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি, রাবার বুলেট, জলকামান, ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পুলিশের গুলি লাগে এক নারীর মাথায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ১০ দিন পর মারা যান।

১৩ ফেব্রুয়ারি: সামরিক জান্তা সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে সন্দেহভাজনদের আটক করতে এবং কারও সম্পত্তি তল্লাশি করতে বাধা দেওয়ার আইন স্থগিত করে।

২২ ফেব্রুয়ারি: সাধারণ মানুষ ধর্মঘট শুরু করেন। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দেশজুড়ে মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়ে অভ্যুত্থানবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন।

অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিবাদ থেকে নির্বাচিত নেতা অং সান সু চির মুক্তির দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা। ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ইয়াঙ্গুন

২৫ ফেব্রুয়ারি: ফেসবুক মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ করে। সেনা সমর্থক প্রায় এক হাজার মানুষ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান।

২৬ ফেব্রুয়ারি: জাতিসংঘে মিয়ানমারের দূত অভ্যুত্থান ঠেকাতে জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। পরদিন বরখাস্ত হন তিনি।

২ মার্চ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জান্তার এক প্রতিনিধির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। সু চির মুক্তি এবং বিক্ষোভে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানান তাঁরা।

৪ মার্চ: মিয়ানমারে ১৯ জন পুলিশ সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁরা বলেন, জান্তার হুকুম মেনে তাঁরা আর কোনো কাজ করতে চান না।

৫ মার্চ: নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা মিয়ানমারের ১০০ কোটি ডলারের একটি অ্যাকাউন্ট অচল করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিছু কিছু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন।

২২ মার্চ: মিন অং হ্লাইং ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসহ অভ্যুত্থানে জড়িত ১১ জনের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

২৭ মার্চ: এদিন একদিকে চলছিল সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ, অপর দিকে সেনাদের গুলিতে অন্তত ১৬ জন অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারী নিহত হন।

২৮ মার্চ: কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সেনাবাহিনীর বিমান হামলার পর কারেন রাজ্যের প্রায় তিন হাজার গ্রামবাসী থাইল্যান্ড সীমান্ত পার হন। আগের দিন সেনার গুলিতে নিহত ১১৪ জনের শেষকৃত্য চলাকালে বাগো নামে ছোট একটি শহরে সরাসরি গুলি চালাতে শুরু করেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

১ এপ্রিল: অং সান সু চির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ভাঙার অভিযোগ আনে সামরিক জান্তা সরকার।

১৬ এপ্রিল: জান্তা সরকারের বিরোধীরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। তাদের সরকারে ক্ষমতাচ্যুত সু চি সরকারের এমপি ও অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের নেতাদের রাখা হয়। সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এই সরকার গঠন করা হয়েছিল।

২৪ এপ্রিল: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নেতারা এদিন বলেন, সংকট নিরসনে মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে একটি পরিকল্পনার ব্যাপারে রাজি হয়েছেন তাঁরা।

২৭ এপ্রিল: থাইল্যান্ড সীমান্তে সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি দখল করে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। এর জবাব দিতে সেখানে বিমান হামলা করে সামরিক বাহিনী।

৪ মে: জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমগুলোয় ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর কার্যক্রম বাতিল করে দেওয়ার কথা জানানো হয়।

২৪ মে: অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতন ও সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর প্রথমবারের মতো সু চিকে আদালতে হাজিরা দিতে দেখা যায়। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দর থেকে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ‘ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের’ আমেরিকান সম্পাদক ড্যানি ফেনস্টারকে (৩৭) আটক করে সেনারা।

৮ জুন: জাতিসংঘ জানায়, দুই পক্ষের লড়াইয়ে কায়াহ রাজ্যের এক লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে বেসামরিক মানুষের বসতি রয়েছে, এমন এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার হামলা চালানোর বিষয়টি নিয়েও কথা বলা হয়।

২১ জুন: মস্কো বৈঠকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি নিকোলাই পতরুশেভ এবং মিন অং হ্লাইং নিরাপত্তা ও অন্য সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।

১ আগস্ট: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। ২০২৩ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করার প্রতিশ্রুত দেন তিনি।

১৮ আগস্ট: নিরাপত্তা বাহিনীর দমনাভিযানে এক হাজার মানুষ নিহত হওয়ার কথা জানায় অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি)।

১৬ অক্টোবর: সংকট নিরসনে গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সম্মেলন থেকে বাদ পড়েন জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং।

২৯ অক্টোবর: সু চির উপদেষ্টা ৭৯ বছর বয়সী উইন হেতেইনকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন জান্তা নিয়ন্ত্রণাধীন মিয়ানমারের আদালত।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী

১৫ ডিসেম্বর: একাধিক অভিযোগে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর আমেরিকান সাংবাদিক ফেনস্টারকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান।

৫ ডিসেম্বর: বিক্ষোভে উসকানি ও করোনা মোকাবিলাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের দায়ে সু চিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুই বছরের জন্য তাঁকে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তবে সু চি কোথায় বন্দী থাকবেন সেটা জানানো হয়নি। প্রথমে সু চির সাজা হয়েছিল চার বছরের। পরে সেনাপ্রধান দুই বছরের সাজা মাফ করে দেন।

৭ জানুয়ারি ২০২২: কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন মিয়ানমারে দুই দিনের সফরে আসেন। তিনি মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে বৈঠকও করেন। অভ্যুত্থানের পর এটাই ছিল কোনো বিদেশি সরকারপ্রধানের প্রথম মিয়ানমার সফর।

১০ জানুয়ারি: বাড়িতে লাইসেন্সবিহীন ওয়াকিটকি রাখা ও সেসব ব্যবহারের অভিযোগে জান্তা–নিয়ন্ত্রিত এক আদালত সু চিকে আরও চার বছরের কারাদণ্ড দেন।

১৪ জানুয়ারি: ৭৬ বছর বয়সী সু চির বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগে সব মিলেয়ে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে সু চির।