মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদো’ নামে পরিচিত। এক বছর আগে দেশটির এই সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে। তার পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন–পীড়ন চালিয়ে আসছে। অনেক শিশুসহ নিজ দেশের শত শত মানুষকে হত্যা করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের (এএপিপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের দমন–পীড়ন অব্যাহত আছে।
‘তাতমাদো’ কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠল, কেনই বা তারা এত নৃশংস, তার সুলুক সন্ধান করেছে বিবিসি। এ নিয়ে বিবিসির অনলাইনে গতকাল মঙ্গলবার একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য গত একটি বছর ছিল রাজপথে নির্বিচার হত্যা ও জনপদে জনপদে রক্তক্ষয়ী অভিযানের একটি বছর। গত বছরের ডিসেম্বরে বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশটির সেনাবাহিনী বিরোধী লোকজনের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যার ধারাবাহিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
বার্মিজ ভাষায় তাতমাদোর সহজ অর্থ ‘সশস্ত্র বাহিনী’। কিন্তু তা বর্তমানে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক কর্তৃত্বের সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। দেশটিতে সেনাবাহিনী বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। আর দেশের বাইরে তাদের রয়েছে কুখ্যাতি।
কয়েক শতাব্দী ধরে বার্মিজ রাজতন্ত্রের একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এই সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়।
তাতমাদোর শেকড় বার্মা ইনডিপেনডেন্স আর্মিতে (বিআইএ) পাওয়া যেতে পারে। ১৯৪১ সালে একদল বিপ্লবী বিআইএ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিপ্লবীদের মধ্যে অং সান ছিলেন। তাঁকে অনেকে দেশটির আধ্যাত্মিক জাতির পিতা হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি অং সান সু চির বাবা।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে অং সান গুপ্তহত্যার শিকার হন। তাঁর মৃত্যুর আগে বিআইএ অন্য মিলিশিয়াদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল একটি জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা। স্বাধীনতার পর গঠিত হয় তাতমাদো।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারে তাতমাদো দ্রুত ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জন করে। ১৯৬২ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। পরবর্তী ৫০ বছর তারা কার্যত বিনা বাধায় দেশ শাসন করে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সরকারি নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রাখে সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী একটি উচ্চ ‘স্ট্যাটাস’ ধারণ করে। ফলে দেশটির অনেক নাগরিকের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দানের বিষয়টি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। যদিও সামরিক অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে হতাশ করেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন লিন হেট অং (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম, কারণ আমি হাতে অস্ত্র নিতে চেয়েছিলাম, যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চেয়েছিলাম, যুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। আমি দুঃসাহসিক কাজ পছন্দ করি। দেশের জন্য আত্মত্যাগের ধারণা পছন্দ করি।’
১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় মিয়ানমারে গড়ে ওঠে সিভিল ডিজ–অবিডিয়েন্স মুভমেন্ট (সিডিএম)। সিডিএমে যুক্ত আছেন চিকিৎসক, নার্স, ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সিডিএমে যোগ দিতে লিন হেট অং সেনাবাহিনীর চাকরি ত্যাগ করেন।
লিন হেট অং বলেন, ‘কিন্তু এখন আমি খুব লজ্জাবোধ করছি। এই প্রতিষ্ঠান (সেনাবাহিনী) সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর নৃশংসভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বোমা, প্রাণঘাতী অস্ত্র ও স্নাইপার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি সেই তাতমাদো নয়, যা আমরা আশা করেছিলাম। এ কারণেই আমি সিডিএমে যোগ দিয়েছি।’
১৩০টির বেশি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী নিয়ে মিয়ানমার গঠিত। দেশটিতে বামার জাতিগোষ্ঠীর বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দেশটির বেশির ভাগ এলিট বামার জাতিগোষ্ঠীর বৌদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব এলিটের চেয়ে নিজেদের বেশি এলিট ভাবে দেশটির সেনাবাহিনী।
তাতমাদো নিজেদের জাতির প্রতিষ্ঠাতা মনে করে। ফলে তারা প্রায়ই কথিত প্রকৃত বার্মিজের মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে।
ব্যাংককের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ গোয়েন রবিনসন বলেন, ‘তারা (সেনাবাহিনী) এই অতি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শে খুব নিবিষ্ট।’
গোয়েন রবিনসন বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সব সময় জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখে আসছে। তারা মনে করে, এসব গোষ্ঠী দেশের ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করতে চায়, যার ফলে কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার কয়েক ডজন ছোট গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। তাই এগুলো অবশ্যই নির্মূল বা স্তব্ধ করা উচিত।
দেশটিতে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীদের একটি জটিল ও প্রতিযোগিতামূলক নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, যাদের সবাই আত্মনিয়ন্ত্রণ চাইছে। এর ফলে তাতমাদোকে সব সময় লড়াইয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। একই সময় তাদের একাধিক স্থানে লড়তে হচ্ছে।
এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রায় বিরামহীন লড়াইকে কিছু পর্যবেক্ষক বিশ্বের দীর্ঘতম গৃহযুদ্ধ বলে মনে করেন।
গোয়েন রবিনসন বলেন, বিষয়টি তাতমাদোকে একটি নির্মম ‘ফাইটিং মেশিনে’ পরিণত করেছে, যারা কেবল রোবটের মতো আদেশ অনুসরণ করে।
অভিযানের পর অভিযান, যুদ্ধের পর যুদ্ধ মিয়ানমারের সেনাদের আগ্রাসী করে তুলেছে। চূড়ান্তভাবে বিষয়টি তাদের নিজ দেশের সীমানার মধ্যেই হত্যাযজ্ঞ চালাতে অভ্যস্ত করে তুলেছে।
মিয়ানমারের কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু, যেমন রোহিঙ্গা মুসলমানেরা দীর্ঘদিন ধরে দেশটির সেনাবাহিনীর জঘন্যতম বর্বরতার শিকার হয়ে আসছে। আর এখন দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জাতিগোষ্ঠীর অনেক বৌদ্ধসহ শত শত বিক্ষোভকারী তাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হচ্ছেন।