মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ ‘দেখা’ অবিশ্বাস্য। যেকোনো গণতন্ত্রকামীর দৃষ্টিতে এ অভ্যুত্থান একটি অপরাধ। আমার চ্যাটবক্সে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে উঠেছে মিয়ানমারের নির্বাসিত একজন সহকর্মীর পাঠানো বার্তা থেকে। ইংল্যান্ডে তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা প্রায়।
মিয়ানমারের সেনারা ১ ফেব্রুয়ারি সাতসকালে মান্ডালে, ইয়াঙ্গুন, তুনগি ও অন্যান্য প্রধান শহরে বেছে বেছে গণতন্ত্রের সমর্থক, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং কর্মীদের বাড়ি ও আশ্রমে যখন তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন ইংল্যান্ডে বসে আমি আমার চ্যাট বক্সে ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে আসা টুকরো টুকরো খবর—কাকে, কখন, কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো, দেখছিলাম।
ওয়াশিংটন থেকে মিয়ানমারের আরেক বন্ধু পোস্ট করলেন, ‘অং সান সু চি রাত ২টা ৩০ মিনিটে আটক।’
আমি ধারাবাহিকভাবে কিছু টুইট করা শুরু করলাম। লিখছিলাম, আমার ধারণা, অভ্যুত্থান ঘটছে। বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে ঘুমাতে গেলাম। কয়েক ঘণ্টা পর জেগে উঠলাম। ‘অভ্যুত্থানের ফিফটি–ফিফটির বেশি সম্ভাবনা’ জানিয়ে পোস্ট করা আমার টুইটগুলোর কথাই বিভিন্ন খবরে ঠিক হতে দেখলাম।
মিয়ানমারের রাজনীতিতে ঘটা অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলি নিয়ে প্রথম কাপ কফি শেষে খবর লেখা শুরু করি। মাত্র বছর পাঁচ আগে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং মিয়ানমারের একজন প্রতিবেদকের একটি প্রশ্নের জবাব বেশ জোর গলাতেই দিয়েছিলেন। প্রশ্নটি ছিল, ‘জেনারেল, (সেনাসমর্থিত) ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি অং সান সু চির কাছে হেরেছে এবং এনএলডি ভূমিধস জয় পেয়েছে। আপনি কি অভ্যুত্থান করে এই ফলাফল পাল্টে দেবেন?’ সেনাপ্রধানের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, ‘ভাবাও যায় না।’
নির্বাচনে এনএলডির জয় ছিল প্রত্যাশিত। কেননা অং সান সু চি (ক্ষমতায়) থাকলেন, টিকেও রইলেন। ভোটাররা সবচেয়ে জনপ্রিয় এই রাজনীতিকের হাতের মুঠোয়ই ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক জনমত থেকে তিনি ছিটকে গেলেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় একপেশেভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যামূলক নিপীড়নের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। এতে মিয়ানমারের ভেতর ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ ভোটারদের মধ্যেই শুধু তাঁর সমর্থন শক্তভাবে বেড়ে ওঠে।
মিয়ানমারের কেউ কেউ জানতেন, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ খোলাখুলি অস্বীকার ও এর ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমারের মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে সু চির আত্মপক্ষ সমর্থন করা ছিল কিছুটা মৌলিক ও কিছুটা রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশের। এটা ছিল একরকমের লোকদেখানো কাজ। যার উদ্দেশ্য ছিল, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতাদের মনে এমন একটি ধারণা তৈরি করা যে সশস্ত্র বাহিনীর জনকের কন্যা হিসেবে তিনি তাঁদের পক্ষে দাঁড়াবেন—এমনকি এ জন্য বিশ্বে তাঁর ভাবমূর্তি বিসর্জন দেওয়ার স্পষ্ট ঝুঁকিতেও যদি পড়তে হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু অং সানের মেয়ে হিসেবে দেশের প্রয়োজনের মুহূর্তে আমি আমার বাবার সন্তানদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে সু চির অবস্থান ছিল খুনি সামরিক নেতাদের কাছাকাছি।
সমস্যা হলো মিয়ানমারের সামরিক নেতারা সু চির অভিপ্রায়কে কখনো আস্থায় বা তাঁর কথাকে ‘সত্যিকার টান’ হিসেবে বিবেচনায় নেননি। অথচ তিনি প্রকাশ্যে তাঁদের ‘আমার বাবার সন্তানেরা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সামরিক বাহিনী এই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লালন করত যে সু চি মিষ্টি কথা বললেও তাঁদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। আর তাঁর দিক থেকে বলতে গেলে, সামরিক বাহিনী, বিশেষত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এমন ধারণা সৃষ্টির পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল।
সু চিকে প্রায় ১৫ বছর ধরে বন্দী করে রেখেছিলেন জেনারেলরা। দেশের বিনির্মাণ ও জাতির পুনর্গঠনের স্বার্থে ওই বাধা কাটিয়ে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতার পথে হাঁটার যথেষ্ট উদার মানসিকতা হয়তো ছিল তাঁর। কিন্তু জেনারেলরা জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে প্রতিষ্ঠা করা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণকে ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন না এবং কার্যত রাষ্ট্র পরিচালনার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁরা। এসব ছিল না সেনাবাহিনীর জনকের কন্যা বা সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য।
২০২০ সালের নির্বাচনে সু চি ও তাঁর দল সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী দল ইউএসডিপিকে একেবারে পর্যুদস্ত করে। দলটি সাবেক জেনারেল ও সামরিক বাহিনীর অন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়া। পার্লামেন্টের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে এনএলডি পায় প্রায় ৪০০টি আসন। বিপরীতে ইউএসডিপি পায় এনএলডির প্রাপ্ত আসনের ১০ শতাংশের কম (৩৩টি)।
দেশের জন্য মৌলিকভাবে একটি অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করা সেনাবাহিনীর নেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল, আইনসভায় সু চি ও এনএলডিকে এমন নেতৃত্বদানকারী অবস্থানে কখনো আসতে না দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আর দুটি নির্বাচনে এটি প্রমাণিত হয়েছে, মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী তাঁদের সবচেয়ে আস্থাহীন কিন্তু জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদদের দিয়ে কখনো নির্বাচনী খেলায় খেলতে এবং জেতার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।
সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্বকারী ইউএসডিপি এবং জাতিগত ও গণতন্ত্রকামী ছোট কিছু রাজনৈতিক দল কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুরে ‘চুরি ঠেকাও’ ও ‘জালিয়াতি’ বলে চিৎকার শুরু করেছে। একে সেনাবাহিনীর নেতারা সু চি ও তাঁর দল এনএলডিকে আঘাত করার এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখেছেন।
সামরিক বাহিনীর পেশাগত জীবনে জেনারেলদের মধ্যে দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকলেও বা কখনো উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাঁরা ধারণ না করলেও ট্রাম্পের মতো করে (বাস্তবে ভিত্তিহীন) ব্যাপক ভোট জালিয়াতির প্রচারণাকে ব্যবহারের একটা পথ পেয়েছেন।
যে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আপনার জেতার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই, তাঁর সঙ্গে কেন এ নির্বাচনী খেলা?
বাকিটা ইতিহাস যা বলে।
১০ বছর ধরে মিয়ানমারের ও মিয়ানমারবিষয়ক অধিকাংশ বিশেষজ্ঞকে পাশ কাটিয়ে আমি প্রকাশ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রহসনমূলক আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক চরিত্র ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে চিৎকার–চেঁচামেচি করেছি। গণতন্ত্রের ওই বড় প্রহসনকে এসব বিশেষজ্ঞ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য ‘শিশুর পদক্ষেপ’ হিসেবে চালাতে সহায়তা করেছেন। আমি গত সোমবার সকালের কয়েকটি ঘণ্টায় যেভাবে অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে ‘দেখেছি’, তাতে পরের দুর্দশায় আমি আনন্দ পাইনি বলাটি হবে অনৈতিক।
যা প্রকৃতই বেদনার, তা হলো আমার বন্ধু ও পরিচিতজনদেরই অনেকে ছিলেন এই অভ্যুত্থানের নায়ক ও ভুক্তভোগী।
উদাহরণ হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ত সোয়ের কথা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় ছেড়ে আমি যখন নিজ ‘দেশ’ মিয়ানমারে ফিরি, তখন প্রভাবশালী এই সাবেক জেনারেল আমাকে ‘একজন রাষ্ট্রীয় অতিথি’ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁকেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে অভ্যুত্থানের যৌক্তিকতা (ভুয়া) তুলে ধরে ক্ষমতা হস্তান্তরের চিঠি পাঠ করে প্রথাগত সাংবিধানিক প্রয়োজন সারতে দেখা গেল। পেশাজীবনে তাঁর কনিষ্ঠ ও বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে তিনি জান্তা সরকারের প্রধান এবং আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সমুদয় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলেন।
আমি বেশ কয়েকজন প্রবীণ ভিন্নমতাবলম্বী ও গণতন্ত্রপন্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং এনএলডি নেতার দেখা পেয়েছি। তাঁদের আমি চিনি, শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি।
একই সময়ে আমি এটিও অনুধাবন করেছি, ওই সব জেনারেল এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন, যাঁরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার অপরাধ সংঘটিত করেছেন। মিয়ানমারের যেসব গণতন্ত্রপন্থী এসব কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছেন ও জেনারেলদের চালানো গণহত্যাকে অস্বীকার করে তাঁদের পক্ষ নিয়েছেন—এ অভ্যুত্থান তাঁদেরও বিরুদ্ধে গেছে।
আরাকানের মুসলিমদের পক্ষে কথা বলে আমি তো মিয়ানমারের ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ ও ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছি। তাই যে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে নিন্দা জানাব ও আমার ভিন্নমতাবলম্বী সাবেক সহকর্মী ও বন্ধুদের জন্য কষ্ট পাব, নাকি বলব, কর্মফল ভয়ানক।
মং জার্নি: গণতন্ত্রপন্থী বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীদের তৃণমূল নেটওয়ার্ক ‘ফোর্সেস অব রিনিউয়্যাল সাউথইস্ট এশিয়া’ (www.FORSEA.co)’ –এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং মিয়ানমারের নির্বাসিত নাগরিক