করোনাকালের জীবনগাথা

মায়ের প্রতীক্ষা, করোনার বিষাদ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

দেশে যাওয়া হয় না অনেক দিন। ইন্টার্ন শেষ করেই মাস্টার্স করতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসা। আগে প্রতিবছর দেশে যাওয়া হলেও এবার তাই লম্বা বিরতি পড়ে গেছে।
করোনার প্রকোপ যখন বেড়ে যেতে থাকে, জানুয়ারির শেষের দিকে— প্রায় সবাই দেশে চলে যায়। তখন ফ্যামিলি থেকে অনেক জোরাজুরিও করা হয় দেশে চলে যেতে। মা তো প্রতিদিন ফোন করে কান্না করত! এরপরেও সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে থেকে যাই। ভেবেছিলাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসুক, তারপরে নাহয় ঘুরে আসব দেশে গিয়ে।

মনে মনে পরিকল্পনা ছিল ঈদে দেশে গিয়ে সবাইকে চমকে দেব একদম, কাউকেই জানাব না। মা তো আশায় বুক বেঁধেছিলেন, ঈদের আগে দেশে যাব। কিন্তু এরই মধ্যে করোনার প্রলংয়করী ঝড় পুরো বাংলাদেশকে লন্ডভন্ড করে দিল। দেশে দিন দিন বাড়তেই আছে আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে!

এখানকার যা পরিস্থিতি, এই ঈদ তো না শুধু—হয়তো পরের ঈদও এখানে একা নিঃসঙ্গ করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পরে, আর দেশের আপডেট রাখি না। এতে শুধু শুধু উত্তেজনা বাড়ে, সিম্প্যাথেটিক সিস্টেম কার্যকর হয়ে, সবকিছু উল্টাপাল্টা করে দেয়। তবুও দেশে কথা হলেই শুনি আজকে এত, এখানে পাওয়া গেছে, ওখানে মরছে—এসব শুনতেও ইচ্ছে করে না আর। এরপরেও ঘুরেফিরে সেই করোনা চলেই আসে। গত প্রায় চারটি মাস এই করোনা নিয়েই বলতে গেলে কারাবাস। না চাইলেও করোনা এসে ঘুরঘুর করে চৌহদ্দিতে।

ইদানীং মা-ও বুঝে গেছেন আমার এই যাত্রায় আর দেশে যাওয়া হচ্ছে না। তাই নিজেকে প্রবোধ দেন, আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি কথা বললেই বুঝতে পারি, মায়ের ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে তার রক্তের শর্করা প্রায়শ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে।

দেশে আক্রান্তের লেখচিত্র যেভাবে এগোচ্ছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কোথায় যাবে আন্দাজ করা মুশকিল। তবে এটি একদম সহজেই বলে দেওয়া যায় যে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে এবং যাবে। লকডাউন শিথিলতা, মানুষের উদাসীনতা, সবকিছু ধীরে ধীরে খুলে যাওয়া—এসব বিষয় করোনা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন হয়তো মেনে নিতেই হবে—করোনাকে নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, করোনার সঙ্গে। আক্রান্ত হবে, সুস্থ হবে অনেকেই, আবার অনেকই ফিরবেন না—যেভাবে না–ফেরার দেশে চলে গেছেন চার লক্ষাধিক মানুষ।

বিশ্বের এত এত উন্নত চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে কূলকিনারা করতে পারছে না, সেখানে আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনো তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে আমরা দিনে দিনে খারাপের দিকেই যাচ্ছি। সবচেয়ে আফসোস হয়, আমরা করোনাকে আটকানোর পর্যাপ্ত সময় পেলেও অবহেলা করে খুইয়েছি সেই সময়গুলো। তার পরিণতি কতটুকু ভয়ংকর হবে, তাই দেখার পালা। ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক অস্থিরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

করোনা নিয়ে লিখতে গেলেই বিষাদে মন নীল হয়ে যায়। মায়ের কথায় ফিরে যায়। মা প্রতিদিন ফোন করে, বিশেষ করে আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে তার যত চিন্তা। যতই বলি না কেন, আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো খাচ্ছি, অনেক ভালো আছি—মা কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারেন না। মায়ের দুচোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারার মতো গলগলিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। সেই অশ্রু দুগাল বেয়ে বেয়ে আমার বাম অলিন্দের কুটুরিতে এসে জমা হতে থাকে। সেখান থেকে রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে। আর হিমশীতল অনুভূতি হয়। মনে হয়, কোষগুলো ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে মরে যাবে। প্রতিটি কোষ‌ অক্সিজেনের জন্য হাহাকার করতে থাকে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার গলা জমাট বেঁধে আসে। আমার ফুসফুসগুলো নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। মুখ দিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণের শক্তিও পাই না।

মায়ের ‌অশ্রুর ভার আমি আর সহ্য করতে পারি না। পাখির মতো উড়ে গিয়ে ইচ্ছে করে তার সেই ‌অশ্রুগুলো মুছে দিতে। আমার মতো ‌অক্ষম একজন সন্তানের সেই ক্ষমতা তো নেই। সেই ক্ষমতা যার আছে, তাই তাকে নিত্য বলতে থাকি, সবকিছু যেন আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমার মতো কোটি সন্তানের মা যেন নিজের নাড়ির ধনকে বুকে নিয়ে একটু আনন্দাশ্রুতে ভাসতে পারে। সেই অশ্রু হবে উষ্ণ, যা শরীরের প্রতিটি কোষকে উজ্জীবিত করে তুলবে—জীবনে বইয়ে দিবে আনন্দের ফল্গুধারা!

*এমডি নিউরোলজি (অধ্যয়নরত), ইয়াংজো ইউনিভার্সিটি, জিয়াংসু, চীন। alavi.mokarrom@gmail.com