গত শুক্রবার ভোর রাতে বাগদাদের বিমানবন্দরে জেনারেল কাশেম সোলাইমানির গাড়িবহর লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হামলায় সোলাইমানিসহ নিহত হন ১০ জন। এর পর থেকে তোলপাড় বিশ্ব রাজনীতি থেকে অর্থনীতিতে। এরই মধ্য বেড়েছে তেলের দাম, পড়েছে অর্থের মূল্য, কেউ কেউ তো এক ধাপ এগিয়ে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন।
তবে এত কিছুর পর এখন একটি প্রশ্ন, কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকার পরও কীভাবে সোলাইমানির গাড়িকে খুঁজে পেল যুক্তরাষ্ট্র। আর কীভাবে হামলা চালানো হলো। এর উত্তর মিলেছে ডেইলি মেইলসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে কাশেম সোলাইমানির ঘাতক মার্কিন অস্ত্রের নাম। সোলাইমানির গাড়িতে হামলা চালানো হয় অত্যাধুনিক মার্কিন ড্রোন ‘এম কিউ-নাইন রিপার’ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় সোলাইমানিসহ ১০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ইরানের ও পাঁচজন ইরাকের। ইরাকের পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন আবু মাহদি আল-মুহানদিস, যিনি ইরানের সমর্থনপুষ্ট খাতিব হেজবুল্লাহ গ্রুপের কমান্ডার এবং ইরাকি মিলিশিয়াদের একটি জোট পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের নেতা ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে সব কূটনীতির খেল খেলতেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের অভিজাত কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানি।
মেইলের খবরে বলা হয়, শুক্রবার ভোররাতে বিমানবন্দর লক্ষ্য করে অন্তত চারটি রকেট নিক্ষেপ করা হয়। বিমানবন্দরে দুটি গাড়ি লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালানো হয়। মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে রকেটগুলো ছোড়া হয়। দুটি গাড়ির একটিতে ছিলেন কাশেম সোলাইমানি। আকাশ থেকে মার্কিন ড্রোনের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে প্রবল বিস্ফোরণ। আর মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় কাশেম সোলাইমানির। সোলাইমানির গাড়িতে ২৩০ কিলোমিটার দূর থেকে হামলা চালানো হয়।
মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন ড্রোন ‘এম কিউ-নাইন রিপার’-এ একবার জ্বালানি ভরলে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত হামলা চলতে পারে। চালকবিহীন ‘এম কিউ-নাইন রিপার’ ড্রোনটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৪৮২ কিলোমিটার পর্যন্ত। ড্রোনটিতে আছে অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা। এই ক্যামেরায় রাতের বেলায়ও যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি পরিষ্কার পাঠিয়ে দেওয়া যায় দূরের কোনো সামরিক ঘাঁটিতে বসে থাকা চালকের মনিটরে।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরো অপারেশনের শেষ পর্যায় ছিল মার্কিন বিমান বাহিনীর এই ড্রোন হামলা। এর আগে সোলাইমানির গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছিল। আর নজরদারির এ কাজে ন্যস্ত ছিলেন মার্কিন ও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা কাশেম সোলাইমানির ফোনের কথোপকথনও শুনছিলেন। কাশেম সোলাইমানির ওপর নজরদারিটা এমন ছিল যে দরকার হলে ড্রোন উড়িয়ে সোলাইমানিকে ধাওয়া করা হতো। কিন্তু বিমানবন্দরের পাশেই চালানো হামলায় নিহত হন কাশেম সোলাইমানি।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাদের তিনটি অপারেশনাল ড্রোন ঘাঁটি রয়েছে। কুয়েতের আলী আল সালেম, কাতারে উদেদ এয়ারবেস, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল দাফর। বাগদাদ বিমানবন্দরে কাছের মার্কিন ড্রোন ঘাঁটি কুয়েতে আলী আল সালেম। তবে সেখান থেকে বাগদাদের দূরত্ব ৫৭০ কিলোমিটার। অন্য দুটি ঘাঁটির দূরত্ব আরও বেশি। আগে থেকেই খবর না থাকলে আশপাশে হামলা চালানো কুয়েতের ঘাঁটি থেকে সম্ভব নয়। তাই সোলাইমানির সঙ্গেই ছায়ার মতো ছিলেন কোনো মার্কিন গোয়েন্দা। সিরিয়া বা লেবানন থেকে ইরানি কমান্ডার কাশেমকে নিয়ে বিমান ছাড়ার পরই তিনি সেই খবর পৌঁছে দেন মার্কিন সেনাদের কাছে। ফলে বাগদাদ বিমানবন্দরের আশপাশে ওত পেতে ছিল মার্কিন ড্রোন ‘এম কিউ-নাইন রিপার’। সোলাইমানি গাড়িতে ওঠার পরই দুটি গাড়ি লক্ষ্য করে চারটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।
পুরো অপারেশনটি জটিল অঙ্কের মতো ধাপে ধাপে সমাধান করেছেন মার্কিন সেনাসদস্যরা। গোয়েন্দা খবর আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের অভিজাত কুদস বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানিসহ ১০ জনের ওপর হামলা চালানো হয়।
এদিকে গালফ নিউজের এক খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার হামলার ২৪ ঘণ্টা পর ঘটনার ঠিক সেই মুহূর্তের একটি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে একটি গাড়িতে হঠাৎ করে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটল। আর এর পরই তাতে আগুন ধরে যায়।
সোলাইমানির মৃত্যুতে ‘বড় ধরনের প্রতিশোধ’ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। ৬২ বছর বয়সী জেনারেল সোলাইমানিকে সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত সমরবিদ মনে করা হচ্ছিল। তিনি মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো সমরজগতের বিশেষ নজরে ছিলেন। সিআইএ-মোসাদের হিটলিস্টে সোলাইমানি ছিলেন বলে বিভিন্ন খবরে জানা যায়।
জেনারেল সোলাইমানি নিজ দেশ ইরানে হাজি কাশেম নামে পরিচিত। তিনি রেভল্যুশনারি গার্ডের একজন কমান্ডার হলেও অলিখিতভাবে তাঁর পদমর্যাদা দেশটির যেকোনো সামরিক কর্মকর্তার ওপরে ছিল।
রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস্ ফোর্স’ সোলাইমানির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছিল। ২১-২২ বছর ধরে বাহিনীটি গড়ে তোলেন তিনি।
‘কুদস ফোর্স’ অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি একটা বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশন ইউনিট’। এই ফোর্সের প্রধান কর্মক্ষেত্র মূলত ইরানের বাইরে। কুদস ফোর্স ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন সোলাইমানি।
সোলাইমানি তাঁর বাহিনীর পুরো কাজকর্মের জন্য আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে জবাবদিহি করতেন। খামেনি জেনারেল সোলাইমানিকে ‘অর্ডার অব জুলফিকার’ পদক দেন। বিপ্লব-উত্তর ইরানে এই খেতাব তিনিই প্রথম পান।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলেসি’ জার্নাল ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা করে। এই তালিকার সমর খাতে জেনারেল সোলাইমানিকে প্রথম স্থানে রাখা হয়। মার্কিন প্রশাসন এই ইরানি জেনারেলকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল। তিনি মার্কিন সরকারের কালো তালিকায় ছিলেন। তিনি ইসরায়েল ও সৌদি আরবেরও মাথাব্যথার কারণ ছিলেন।