আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আফগানিস্তানে নতুন করে দুর্যোগ দেখতে না চায়, তাহলে দেশটিতে মানবিক সহায়তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আফগানিস্তানে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর দেশটিতে গুরুতর মানবিক সংকট সুনামির মতো আছড়ে পড়েছে। তালেবান বাহিনী আগের সরকারের নিরাপত্তা বিভাগসহ অন্য কিছু প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে বের করছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার আফগান। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। নারী চাকরিজীবীদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। এমনকি যে সরকারি কর্মীরা চাকরি ছাড়েননি, তাঁরাও বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তাঁদের সঞ্চিত অর্থ তুলতে পারছেন না। গত সরকারের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ব্যাপারে তালেবানের কঠোর মনোভাবের কারণে জনগণের মৌলিক সেবাগুলো চালু করার প্রচেষ্টা শতভাগ সফল হয়নি। দেশের বিভিন্ন অংশে চলা সাম্প্রতিক লড়াই বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে এবং তাদের সামনে টিকে থাকার মতো কোনো অবলম্বন নেই।
আফগানিস্তানে শীতকাল আসন্ন। পার্বত্য দেশটিতে জেঁকে বসবে শীত। এ সময় লাখ লাখ মানুষের জন্য নিয়মিত খাবার জোটানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। শীতের কবল থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখাও তাদের জন্য সমান কঠিন। অত্যাসন্ন এ বিপর্যয় এড়ানোর একমাত্র উপায় জাতিসংঘের তদারকি ও নজরদারিতে মানবিক সহায়তা পরিচালনা করা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আফগানিস্তানে নতুন করে দুর্যোগ দেখতে না চায়, তাহলে দেশটিতে মানবিক সহায়তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মধ্য এশীয় তিন প্রতিবেশীর সঙ্গে আফগানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহু দিনের। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত বন্ধ রাখার নীতির কারণে এই প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ততটা জোরালো হতে পারেনি। এমনকি সোভিয়েতের পতনের পরও মধ্য এশিয়ার স্বাধীন দেশগুলো মানুষের মধ্যে সংযোগ জোরদারের লক্ষ্যে সীমান্ত খুলে দেওয়ার উদারতা দেখায়নি।
এ কারণে কয়েক দশক ধরে আফগান শরণার্থী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য হয়ে আছে পাকিস্তান ও ইরান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান এবং ইরান সাধারণ আফগানদের ক্ষেত্রে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। দেশ দুটি সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছে। এমনকি চিকিৎসার জন্যও আফগানদের পাকিস্তানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভিসার কড়াকড়িতে আটকা পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। নিকট প্রতিবেশীদের দেশ দুটির এই অবন্ধুসুলভ নীতি সাধারণ আফগানদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে।
এই দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে চরমপন্থী ও কঠোর তালেবান সরকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, যা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। একই সঙ্গে তা তালেবানের শাসনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্যও বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘বদলে যাওয়া তালেবান’ নিয়ে তাদের পাকিস্তানি পৃষ্ঠপোষকদের দাবির সঙ্গে সম্প্রতি তালেবানের কট্টরপন্থী নেতাদের নিয়ে একতরফা সরকার গঠনের বিষয়টি একেবারেই মেলে না। তালেবানের এই সরকার কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন থেকে নারীদের সম্পূর্ণ বিতাড়নের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া বেশ কিছু খ্যাতনামা নারী অধিকার কর্মী যথার্থই একে ‘লৈঙ্গিক বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তাজিক, উজবেক, হাজারা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ তালেবান সরকারে নেই বললেই চলে। তাদের মধ্য থেকে যতটা প্রতিনিধিত্ব আছে, তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
আফগান রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো তালেবানের কট্টরপন্থীদের অনড় আদর্শগত অবস্থান। তারা রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থায় ন্যূনতম মাত্রায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড গ্রহণেও নারাজ। ফলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সাধারণ আফগান জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
তালেবানের এই কট্টরপন্থীরা দুই দশক স্থায়ী যুদ্ধে তাঁদের আত্মঘাতী হামলাগুলোকে নিজেদের ‘বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, ‘শুদ্ধ শরিয়াহ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আত্মঘাতী হামলা চালাতে অনুপ্রাণিত করেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, তালেবানের বর্তমান আমির (সর্বোচ্চ নেতা) আখুন্দজাদা হাইবাতুল্লাহর এক ছেলেও আত্মঘাতী হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভায় কিছু অযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন এই সত্যকেই ন্যায্যতা দেয় যে তাঁদের সন্তানেরাও আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ছিলেন।
মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের নেতৃত্বাধীন তথাকথিত মধ্যপন্থীরা বলে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা দোহা চুক্তির প্রতি তালেবানকে অবশ্যই কিছু সম্মান দেখাতে হবে, যার বদৌলতে তারা যুদ্ধের বড় পক্ষ হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজধানী কাবুলের ওপর হাক্কানি নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও শঙ্কিত এই মধ্যপন্থীরা। যদিও হাক্কানি নেটওয়ার্ক এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানের অংশ, কিন্তু তারা পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে।
এদিকে ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্স (আইএস-কেপি) তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে, বিশেষ করে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে তারা হরহামেশাই হামলা করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী হামলাটি চালায় ৭ অক্টোবর। কুন্দুজ শহরের একটি শিয়া মসজিদে চালানো এ হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হন।
কিন্তু আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তালেবান শাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে তাদের শাসনব্যবস্থার কৌশলগত ঘাটতি। টেকনোক্র্যাট ও ব্যুরোক্র্যাটদের (আমলা) জন্য দরজা বন্ধ করে রেখেছে তারা। এটা মোল্লাদের সরকার, মোল্লাদের দ্বারা সরকার এবং মোল্লাদের জন্য সরকার। কিন্তু এই মোল্লাদের আধুনিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।
দেশের বাইরের সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে তালেবানের। পাকিস্তানকে তালেবানের অধীনে থাকা আফগানিস্তানের অভিভাবক ভাবার সব বাস্তবিক কারণই রয়েছে। তবে তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে তিনটি জটিল প্রশ্নও রয়েছে। এক. পাকিস্তান ও তালেবানের এই প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক কি সাধারণ আফগানদের চোখে তালেবানের গ্রহণযোগ্যতাকে খর্ব করবে না, যারা তালেবানকে পাকিস্তানের হাতের পুতুল ভাবে? দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ তীব্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে জেরবার আফগানিস্তানের ওপর কি পাকিস্তান তার দাদাগিরি অব্যাহত রাখতে পারবে? এবং তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের লড়াই—যা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে পারে, তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা কি ইসলামাবাদের আছে?
ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে দ্রুতগতিতে বদলাচ্ছে, তাতে এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।