যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কে কি ফাটল ধরছে? এ বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য না পাওয়া গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইন্ডি শেরম্যান সম্প্রতি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদ সফরের আগে মুম্বাইয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তাঁর দেশের যে গভীর সম্পর্ক, তা বাইডেনের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে স্থাপন করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দুই দিনের ইসলামাবাদ সফরকে ‘একটি সুনির্দিষ্ট ও সীমিত উদ্দেশ্যে’ হচ্ছে বলে মুম্বাইয়ের ওই অনুষ্ঠানে জানান মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শেরম্যান। তিনি বলেন, আফগানিস্তান ও তালেবান বিষয়ে কথা বলতেই তিনি পাকিস্তান যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করার মতো কোনো কারণ দেখছি না।
তা ছাড়া ‘ভারত-পাকিস্তান’ শব্দ একসঙ্গে উল্লেখ করে ইসলামাবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দিনগুলো ফিরিয়ে আনার কোনো ইচ্ছাও নেই আমাদের।’ পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন আর সেই দিনগুলোতে নেই; আর সেখানে যেতেও চাই না।’
সফরে পাকিস্তান শেরম্যানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর বৈঠকে পূর্বনির্ধারিত কোনো আলোচ্যসূচি ছিল না। পাকিস্তান সরকারের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগের সমাধান দরকার। কিন্তু উদ্বেগ নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে কোনো ফোনকল না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান বেশ অসন্তুষ্ট হন।
এদিকে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের উপপরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককে ফলপ্রসূ মনে করছেন। ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি (শেরম্যান) পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত বক্তব্য দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি পাকিস্তানের বিষয়ও বুঝতে পারবেন বলে আমার মনে হয়।’
আফগানিস্তান থেকে গত ৩১ আগস্টের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার সময় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। ওই সময় তিনি বলেন, নতুন করে আঞ্চলিক কূটনীতির ওপর জোর দিতে চান তিনি।
আঞ্চলিক কূটনীতি ওপর জোর দেওয়ার এমন ঘোষণার পরও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন না করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, আফগানিস্তান ইস্যুতে ইমরান খানের মনোভাবে ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ। এর আগে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া ও তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণকে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন ইমরান খান। অথচ যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল, তালেবানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামতকে গুরুত্ব দেবে পাকিস্তান।
দীর্ঘদিনের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হওয়াটা ইসলামাবাদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগমুহূর্ত পর্যন্তও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সুসম্পর্ক ছিল।
বাইডেনের আমলে রাতারাতি হারানো এ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে পাকিস্তান অবশ্য মরিয়া। কতটা মরিয়া সেটি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি চিঠিতে জানা গেছে। চিঠিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসকে বাইডেন ও ইমরানের মধ্যে ফোনকলের ব্যবস্থা করতে বলেছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘আফগানিস্তান পরিস্থিতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তান। কিন্তু এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে পাকিস্তানের এই নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে হোয়াইট হাউস এখনো উদাসীন।’ বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে এটিকে ‘হোয়াইট হাউসের অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত’ বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠির বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি এটিকে ভুয়া বলেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চিঠির সত্যতা স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে ইমরানকে বাইডেনের ফোনকল করা বিষয়ে জানতে চাইলে হোয়াইট হাউস বলেছে, তাদের কাছে এ বিষয়ে বলার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। গত মাসের শেষ দিকে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, এ বিষয়ে এই মুহূর্তে তিনি কিছুই অনুমান করতে পারছেন না।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ‘দ্বৈত খেলার’ অভিযোগ রয়েছে। যেমন এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সহযোগী হিসেবে পাকিস্তান কাজ করছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তালেবানকে সমর্থনদান ও অর্থায়ন করা এবং নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করা ও তালেবানকে সংগঠিত করার অভিযোগ রয়েছে।
এই বিষয়ে কলাম লেখক ও বিশ্লেষক সিরিল আমিডা বলেন, ‘৯/১১–এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের চোখে দেখছে। বর্তমানে পাকিস্তান মনে করছে, তারা আফগানিস্তানে পরাশক্তিগুলোর বিপক্ষে ছায়াযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। আর এ কারণেই পরাশক্তির দেশগুলো তার কোনো ত্রুটি ক্ষমা করা বা ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই।’
আগস্টের মাঝামাঝি তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই তালেবান সরকারের স্বীকৃতির জন্য পাকিস্তান প্রকাশ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে। তালেবান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সুসম্পর্ক রয়েছে।
গত সপ্তাহে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেন, ‘আজ হোক বা কাল, আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে।’
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকেরা শঙ্কায় রয়েছেন, পাকিস্তান যেকোনো সময় তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে। আফগানিস্তানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে পাকিস্তান বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডনের প্রতিবেদনে মার্কিন সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগে পাকিস্তান একতরফা তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে, যুক্তরাষ্ট্র তা চায় না।
‘নো উইন ওয়ার: প্যারাডক্স অব ইউএস-পাকিস্তান রিলেশনস ইন আফগানিস্তানস শ্যাডো’ বইয়ের লেখক জাহিদ হুসেন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, ‘এই সম্পর্ক ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। দুই দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক কাজ করছে না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক নেই, শুধু লেনদেনসংক্রান্ত সম্পর্ক রয়েছে।’
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের বেশ পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানে সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ইমরান খানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চান বাইডেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এ বছরই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষমতা হরণের মতো অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ভাষান্তর: মেহেদি হাসান