মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারত। তবে সংখ্যায় বেশি হলেও আইনপ্রণেতা হিসেবে এই সম্প্রদায়ের লোকজন হাতে গোনা। এবার দেশটির লোকসভা নির্বাচনে সেই ছাপ বড় বেশি স্পষ্ট। লোকসভা নির্বাচনের দৌড়ে সেভাবে নেই মুসলিমরা। দলের টিকিটে আগে নির্বাচনের সুযোগ পেয়েছিলেন, নির্বাচিতও হয়েছিলেন, এমন কেউ কেউ এবার বাদ পড়েছেন মনোনয়ন থেকে। ভারতের রাজনীতিতে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণ।
বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই মুসলিম নেতাদের গল্প।
বিহার রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের সংসদীয় আসন মধুবানি। এ আসনে এবার লড়ছেন রাজনীতিতে অভিজ্ঞ শাকিল আহমেদ (৬৩)। গায়ে ফোসকা পড়া গরমের মধ্যে মোটরসাইকেলে চড়ে ধুলো উড়িয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। প্রবীণ এই রাজনীতিকের জন্য নির্বাচন নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। এর আগে এই আসনে টানা দুবার তিনি কংগ্রেসর হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এবার তফাত হলো দলের মনোনয়ন পাননি তিনি। লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
শাকিল আহমেদ বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। তবে এপ্রিল মাসে কংগ্রেস যখন জানিয়ে দিল মধুবানি আসনে তাঁকে মনোনয়ন দেবে না, তখন সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো এক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কংগ্রেসের সঙ্গে সুদীর্ঘ পথচলার ইতি টানেন। এরপর ওই আসন থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। শাকিলের এই চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগান সর্বস্তরের মুসলিম সমর্থকেরা।
তবে ঘটনাটি মুসলিমদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি করেছে। রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব সংকুচিত হওয়ার বিষয়টি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন তাঁরা।
দলের জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র শাকিল আহমেদকে মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়টিও বিস্ময়কর। শাকিল কোনো সাধারণ প্রার্থী নন। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং কনিষ্ঠ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর বাবা ও দাদা দুজনই কংগ্রেসের নেতা এবং বিহার রাজ্য সভার আইনপ্রণেতা ছিলেন।
বিহারের সামাজিক-ধর্মীয় ইসলামি সংগঠন ইমারাত শরিয়াহের সেক্রেটারি মাওলানা আনিসুর রহমান কোয়াজমি বলেন, ‘শাকিল আহমেদের মতো কংগ্রেসের বড় মাপের নেতাকে নিজ আসনের জন্য ভিক্ষা চাইতে হয়েছে। তিনি এখন যা করছেন, তা নিঃসন্দেহে সাহসিকতার পরিচায়ক, তবে এই কাজ তাঁর আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিল। কেবল মুসলিমরাই কংগ্রেসকে জেতাতে পারে। আমাদের বিরুদ্ধে ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে। তোমরা (কংগ্রেস) মুসলিমদের বলো তোমাদের ভোট দিতে, অথচ মুসলিম প্রার্থীদেরই নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করার টিকিট দাও না।’
দিল্লিতে কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী নেই
ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় কংগ্রেসের সুনাম রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির সঙ্গে এখানে তাদের ভিন্নতা রয়েছে। তবে নির্বাচনে তারা মুসলিমদের সুযোগ কম দেওয়ায় মুসলিম ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিহারের ১২০ জন প্রার্থীর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা মাত্র আট।
গত মাসে দিল্লির জ্যেষ্ঠ মুসলিম কংগ্রেস নেতা শোয়াইব ইকবাল, মার্টিন আহমেদ, হাসান আহমেদ ও আসিফ মোহাম্মদ খান পার্টির প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীকে সতর্ক করে এক চিঠি লিখেছেন। তাঁরা জানান, দিল্লিতে কোনো মুসলিম প্রার্থী না থাকার বিষয়টি জনগণকে রুষ্ট করছে। তাঁদের মতে, চাঁদনি চক বা উত্তর-পূর্ব দিল্লির অন্তত একটি সংসদীয় আসন মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। তবে তাঁদের সেই অনুরোধে সাড়া দেননি রাহুল। দিল্লিতে নেই কংগ্রেসের কোনো মুসলিম প্রার্থী।
দলের সিদ্ধান্তর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন কংগ্রেসের জাতীয় গণমাধ্যম সমন্বয়কারী সঞ্জীব সিং। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব, আমরা করেছি। নির্বাচনে যাঁদের টিকিট দেওয়া সম্ভব, দিয়েছি। ২০১৪ সালের তুলনায় এবার আরও একজন মুসলিম প্রার্থীকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। তবে জোট রাজনীতির কাছে আমাদেরও হাত-পা বাঁধা।’
কমেছে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব
১৯৮০ সালে ভারতের পার্লামেন্টে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ছিল ৯ শতাংশ, ২০১৪ সালে এসে যা ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি যে কেবল ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। ধীরে ধীরে কয়েক দশক জুড়েই সংসদে মুসলমানদের প্রতিনিধি কমেছে। এ কারণে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছে মুসলিম প্রার্থী ও ভোটারদের। কারণ, মুসলিম অংশগ্রহণের বিষয়ে এত দিন কংগ্রেসের ওপরই শুধু তাঁরা ভরসা করতে পারতেন।
ক্ষমতাসীন বিজেপি চলমান লোকসভা নির্বাচনে কেবল সাতজন মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। অথচ ৫৪৫ সদস্যবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষে আসনসংখ্যা ৪৩৭। ২০১৪ সালেও তারা মাত্র সাতজনকেই প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল, যাঁদের কেউ জয়ের মুখ দেখেননি। সেবার ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধি ছিল না।
২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৪৬৪ আসনের বিপরীতে ৩১ জন মুসলিম প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে কেবল সাতজন বিজয়ী হন। এ বছরেরও সেই চিত্রের খুব একটা হেরফের হয়নি। দলটির ৪২৩ জন প্রার্থীর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা ৩২।
অধ্যাপক হিলাল আহমেদ জানান, ইসলাম ধর্মে বর্ণপ্রথার কোনো স্থান নেই এবং মুসলিমরা সবাই একই রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন। তাই বলে তাঁরা কেবল নিজেদের ইস্যু চিন্তা করেই ভোট দেন না। ভালো রাস্তা, স্কুল, চাকরি—এগুলো তো সবারই প্রত্যাশা।
তারপরও ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে বলে জানান মধুবানি এলাকার বাসিন্দারা। শাকিল আহমেদের এই উদ্যোগকে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন। বিজেপির কাছ থেকে তাঁদের আগে থেকেই কোনো প্রত্যাশা ছিল না, এবার কংগ্রেসের সিদ্ধান্তেও হতাশা জানিয়েছেন মুসলিম ভোটাররা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার জেফরিলট ভারতের পার্লামেন্টে মুসলিমদের অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। ২০১৬ সালে এক সভায় তিনি জানান, নির্বাচনে তরুণদের অংশগ্রহণ জরুরি। কারণ, তাঁদের হাত ধরেই সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে পার্লামেন্টে মুসলিম সদস্যরাই মুসলমানদের সমস্যার ২৩ শতাংশ নিয়ে কথা বলেছেন। কাজেই মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা যত কমবে, মুসলিমদের অধিকার আদায়ের পথও ততটাই বন্ধ হবে বলে মনে করেন ক্রিস্টোফার।
মুসলিম সম্প্রদায় এখন এই কথাই অন্তর থেকে উপলব্ধি করছে। তাদের হয়ে কথা বলার জন্য যোগ্য প্রতিনিধি প্রয়োজন।