বিশ্বজুড়েই বাক্স্বাধীনতা এখন হুমকির মুখে। নিজের মনোভাব স্বাধীনভাবে প্রকাশ করাই যেন পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল—সব ধরনের রাষ্ট্রেই সরকারযন্ত্র বাক্স্বাধীনতাকে পাত্তা দিতে চাইছে না। কখনো চাপ প্রয়োগ করে, আবার কখনো সহিংসতার মাধ্যমে দমন করা হচ্ছে ভিন্নমত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, মুখ খোলার আগে ভয় জাগছে, জিব থাকবে তো?
বাক্স্বাধীনতা দমনের এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক থেকে একনায়কতান্ত্রিক, সব ধরনের রাষ্ট্রে। যে যুক্তরাষ্ট্র এত দিন ধরে অন্যদের গণতন্ত্রের মান সমুন্নত রাখার সবক দিয়ে আসছে, সেই দেশের প্রেসিডেন্টও অপ্রিয় প্রশ্ন করায় সাংবাদিককে ‘জনগণের শত্রু’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকিও বাদ যাচ্ছে না! রাষ্ট্রের মাথাদের এমন আচরণ সমাজেও অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে, সমাজ রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় বিভাজিত হয়ে পড়ছে। সেই বিভক্তি এমন পর্যায়ে যাচ্ছে, যেখানে ভিন্নমতের কাউকে ‘শয়তান’ বলে মনে করা হচ্ছে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্নমতের সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখার মানসিকতা, মানুষের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার বাতিল করে দেওয়ার প্রবণতা।
বাক্স্বাধীনতা শুধু গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নয়। মানবসভ্যতার সামগ্রিক প্রগতির চাকা চালু থাকে মুক্তমতের ডানায়। যতক্ষণ একজন মানুষ নিজের মনোভাব মুক্তভাবে ব্যক্ত করতে পারে না, ততক্ষণ কেউ পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারে না। যদি ভিন্নমতের সঙ্গে কারও পরিচয়ই না হয়, তবে মনের জানালা খুলবে কীভাবে? অবশ্য বিভিন্ন দেশের সরকার এখন নাগরিকদের কূপমণ্ডূক বানাতেই বেশি আগ্রহী। তাই নিত্যনতুন পদ্ধতিতে সেলাই করে দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের মুখ।
বাক্স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা অনেক কঠিন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী ধারাবাহিকভাবে বাক্স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হয়েছে। সাধারণত যেসব রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠী বেশি দমনমূলক, সেখানে বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার ঘটনাও বেশি ঘটে। এসব দেশে বাক্স্বাধীনতা একেবারেই নেই বলেই মনে করে ফ্রিডম হাউস। গত পাঁচ বছরে এমন তালিকায় থাকা দেশগুলোর ২৮ শতাংশ মুক্তমত ঠেকাতে আরও কঠোর হয়েছে। মাত্র ১৪ শতাংশ নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল করেছে। আর বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একেবারেই স্বাধীন দেশগুলোর ১৯ শতাংশ (১৬টি দেশ) গত পাঁচ বছরে এ বিষয়ে রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। মাত্র ১৪ শতাংশ এ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পেরেছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে বাক্স্বাধীনতা খর্বসংক্রান্ত নানা ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঘৃণা কথাবার্তা বা ‘হেট স্পিচ’ ঠেকানোর নামে আটকানো হচ্ছে ‘ফ্রি স্পিচ’। এর জন্য আইনও করা হচ্ছে। তবে অভিযোগ আছে, ঘৃণা বাক্য আটকানোর চেয়ে ভিন্নমত দমন করার ক্ষেত্রেই এসব আইন বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন: গত জুনে ইথিওপিয়ায় ‘ক্যু’ সংঘটিত হওয়ার পর থেকে নানা ধরনের উড়ো খবর শোনা যেতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থাই অচল করে দেয় সরকার। ফলে দেশটির ৯৮ শতাংশ নাগরিক চলে যায় অন্ধকারে। আবার চলতি মাসেই ভারত সরকার কাশ্মীরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়, বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও। কোনো সংকট তৈরি হলেই যোগাযোগের সব ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার এই নীতি এখন হরহামেশাই নেওয়া হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছর মোট ২৫টি দেশের সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে।
নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতার প্রতি সরকারগুলোর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠার কিছু কারণ আছে। ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, প্রথমত, নানা দেশের শাসক দলগুলো ভিন্নমত ও ধারণা দমন করার জন্য নিত্যনতুন পদ্ধতি পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোসহ সাধারণ নাগরিকের ওপর নজরদারি করা সহজ হয়ে গেছে। ফলে ভিন্নমত দমন করা এখন আর জটিল কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, সরকারগুলো ভিন্নমত দমনে আগ্রহী হচ্ছে বৈশ্বিক প্রবণতার কারণে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করতে চাইছে। নিন্দুকেরা বলেন, চীন নিজেদের ঘরে ভিন্নমতকে কোনো গুরুত্বই দিতে রাজি নয়, উল্টো বাইরের দেশগুলোতে রপ্তানি করছে নজরদারি করার প্রযুক্তি। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো পক্ষে না গেলেই সব খবরকে ‘ফেক নিউজ’ বলে দেন। এই যখন অবস্থা, তখন অন্যরা তো উৎসাহিত হবেই।
বিপদে সাংবাদিকেরা
বাক্স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবচ বলে মনে করা হয়। সংবাদমাধ্যমের অন্যতম কাজই হলো সরকারের নানা পদক্ষেপের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করা। কিন্তু মন্দ বললেই খেপে যাচ্ছে সরকারগুলো। আর কে না জানে, মুখ বন্ধ করার সবচেয়ে মোক্ষম উপায় হচ্ছে বক্তাকে মেরে ফেলা। আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে কমপক্ষে ৫৩ জন সাংবাদিককে কর্মরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। আগের দুই বছরের তুলনায় এই সংখ্যা বেশি। অথচ এসব খুনের ঘটনায় খুব কম ক্ষেত্রেই খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকারের সঙ্গে তাল না মেলানোয় বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে। চলছে ধরপাকড়। সিপিজে বলছে, ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে কর্মসূত্রে আড়াই শতাধিক সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে কমপক্ষে ৬৮ জন, চীনে ৪৭ জন, মিসরে ২৫ জন ও ইরিত্রিয়ায় ১৬ জনকে জেলে পোরা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকদের ধারণা, আটক সাংবাদিকের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক সাংবাদিককে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া গোপনেও আটক করা হচ্ছে।
স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আর্থিক ফাঁদে ফেলার চেষ্টাও চলছে। ইকোনমিস্ট বলছে, সারা বিশ্বে বিজ্ঞাপন বাবদ আয় কমে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে শাসক দলগুলো। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরিয়ে নিয়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে সংকটে ফেলা হচ্ছে। আবার সরকারপক্ষের ব্যবসায়ীদের দিয়েও অনুগত সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ফলে সংকুচিত হচ্ছে স্বাধীন সংবাদপ্রবাহ, সেই জায়গা নিচ্ছে আপসকামী সাংবাদিকতা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের উচিত বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ রাখা। সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে বা সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত নয়, এমন বক্তব্যকে অবৈধ ঘোষণা করা যেতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সেই ধুয়া তুলে অন্যান্য মতকে দমন করা উচিত নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতাই এখন বেশি জনপ্রিয়। আর পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের দেখাদেখি সব দেশের সরকারই এই পদ্ধতিতে আস্থা রাখতে শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে ভিন্নমত প্রকাশ বা বাক্স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো দিন দিন আরও বিবর্ণ রূপ ধারণ করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সেই আশঙ্কা সত্যি হয় কি না, তা-ই এখন দেখার।