বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের হাতেই 'ট্রাম্প কার্ড'!

সাদা চোখে মনে হচ্ছে, চীনের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের দেশও কিছু ক্ষেত্রে চীনের মুখাপেক্ষী। ছবি: রয়টার্স
সাদা চোখে মনে হচ্ছে, চীনের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের দেশও কিছু ক্ষেত্রে চীনের মুখাপেক্ষী। ছবি: রয়টার্স

শুল্ক বাড়িয়ে শুরুটা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর এল টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা। সাদা চোখে মনে হচ্ছে, চীনের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের দেশও কিছু ক্ষেত্রে চীনের মুখাপেক্ষী। আর তা দিয়েই বাজিমাত করতে পারেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিনির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে বিরল ধাতু বা দুর্লভ খনিজ পদার্থ নিয়ে। এই বস্তুগুলোর উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিক থেকে চীনের কাছাকাছিও কেউ নেই। মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিরল ধাতুর বৈশ্বিক রিজার্ভের ৩৭ শতাংশ আছে চীনে। আর এই বিরল ধাতু ব্যবহৃত হয় নানা কাজে। স্মার্টফোন, উড়োজাহাজ ও চিকিৎসা উপকরণ তৈরিতে প্রয়োজন হয় বিরল ধাতু। যেমন: স্মার্টফোনের স্পিকার তৈরির জন্য নিওডিমিয়াম নামের বিরল ধাতু প্রয়োজন হয়। এই নিওডিমিয়াম দিয়ে তৈরি হয় এক বিশেষ ধরনের চুম্বক। সেই চুম্বকই ব্যবহার করা হয় স্মার্টফোনের স্পিকারে। এ ছাড়া সামরিক কাজেও ব্যবহৃত হয় এসব পদার্থ। বিশেষ করে স্টিলথ প্রযুক্তিসম্পন্ন অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার তৈরিতেও প্রয়োজন হয় দুর্লভ খনিজ পদার্থ।

সংবাদমাধ্যম ফোর্বস বলছে, দুর্লভ খনিজ পদার্থ ঠিক অতটা দুর্লভ নয়। চীন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, বুরুন্ডি, মিয়ানমার, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া ও ভিয়েতনামেও বিরল ধাতুর বড় রিজার্ভ আছে। তবে সমস্যা হলো, যে প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিতে দুর্লভ খনিজ ব্যবহারের উপযোগী হয়, সেই পদ্ধতি জটিল। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়া মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য এই ঝুঁকি নিতে খুব একটা উৎসাহী নয়। আর এভাবেই বিরল ধাতুর বাজারে একাধিপত্য বিস্তার করেছে চীন।

দুর্লভ খনিজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিক থেকে চীনের কাছাকাছিও কেউ নেই। মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিরল ধাতুর বৈশ্বিক রিজার্ভের ৩৭ শতাংশ আছে চীনে। ছবি: রয়টার্স

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিরল ধাতুর বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় পুরোটাই ছিল চীনের দখলে। এখন অবশ্য তা কিছুটা কমেছে। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এখনো বিরল ধাতুর মোট উৎপাদনের ৯০ ভাগ চীন থেকে আসে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরল ধাতুকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে চীন। কারণ, যদি দেশটি বিরল ধাতুর সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক পণ্যের উৎপাদন বন্ধও করে দিতে হতে পারে।

এরই মধ্যে এ নিয়ে চীন ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছে। চীনা গণমাধ্যম বলছে, গত মাসে দেশটির একটি বিরল ধাতু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা সফর করেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। এরপরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক মুখপত্র পিপলস ডেইলি বিরল ধাতু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধারণা সামনে নিয়ে আসে। পিপলস ডেইলি বলছে, এই একটি পথেই যুক্তরাষ্ট্রকে সীমাহীন ‘যন্ত্রণা’ দিতে পারবে চীন।

মজার বিষয় হলো, দুর্লভ খনিজের বাজার খুব বড় নয়। মার্কিন সরকারি নথিপত্রের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে ১৬০ মিলিয়ন ডলারের বিরল ধাতু আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ এই রপ্তানিতে যদি চীন নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে, তাতে চীনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি হবে বহুমাত্রিক। কারণ, বিরল ধাতুগুলোর সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি, অনেক ক্ষেত্রেই আটকে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি নামের একটি থিংক ট্যাংকের জ্যেষ্ঠ ফেলো মারটেইন র‌্যাসার বলছেন, ডলারের হিসাব অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে চীনের খুব একটা ক্ষতি হবে না। কিন্তু বেকায়দায় পড়বে যুক্তরাষ্ট্র।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রেও বিরল ধাতুর খনি আছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়্যারড বলছে, ক্যালিফোর্নিয়ার ওই খনিতে আছে বিরল ধাতুর বৈশ্বিক রিজার্ভের মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু এই অল্প পরিমাণ বিরল ধাতুও খনি থেকে উত্তোলনের পর চীনে পাঠাতে হয়। কারণ, চীনেই এসব ধাতু প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রক্রিয়াজাত করার এই পদ্ধতি যেমন জটিল, তেমনি এর ফলে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও সৃষ্টি হয়। তাই সি চিন পিংয়ের দেশ যদি বিরল ধাতু রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত করা বন্ধ করে দেয়, তবে দ্রুতই বিপদে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। তবে দীর্ঘ মেয়াদে চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ।

অবশ্য বিরল ধাতুকে অস্ত্র হিসেবে আগেও ব্যবহার করেছে চীন। ২০১০ সালে এসব ধাতুর রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল চীন। ২০১২ সালের দিকে এই নিষেধাজ্ঞা চীন প্রত্যাহার করে। ওই সময় থেকেই চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে কাজ করছে মার্কিন সরকার। তবে এখনো তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

বিরল ধাতু ব্যবহৃত হয় নানা কাজে। স্মার্টফোন, উড়োজাহাজ ও চিকিৎসা উপকরণ তৈরিতে প্রয়োজন হয় বিরল ধাতু। বিশেষ করে স্টিলথ প্রযুক্তিসম্পন্ন অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার তৈরিতেও প্রয়োজন হয় দুর্লভ খনিজ পদার্থ। ছবি: রয়টার্স

বিরল ধাতুর রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ঝামেলা আছে চীনেরও। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ক্রেতারা চীনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন। এতে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনেই ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়বে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে বিরল ধাতুর একচেটিয়া ব্যবসা হাতছাড়া হতে পারে চীনের।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে আর্থিক লাভ-ক্ষতি নিয়ে কম ভাবছে দুই পক্ষই। বরং একে-অপরকে কোণঠাসা করায় আগ্রহ বেশি। শেষ পর্যন্ত এটি ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিরল ধাতু দিয়ে মোক্ষম অস্ত্রই বানাতে পারেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং!