পাকিস্তান–আফগানিস্তান

পাকিস্তান যখন কাবুলের মুখাপেক্ষী

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান ও তালেবানের দৃশ্যপট যেভাবে পাল্টে গেল, তা বেশ কৌতুকপ্রদ।

গত বছর তালেবান ক্ষমতা দখলের পর বিভিন্ন দেশ যখন আফগানিস্তান থেকে কূটনৈতিক মিশন গুটিয়ে নিচ্ছে, তখন কাবুল সফর করেন পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
ফাইল ছবি:  এএফপি

আফগান তালেবানের সঙ্গে ন্যাটোর দর–কষাকষি হতো কাতারের দোহায়। সারা বিশ্ব সেদিকে তাকিয়ে থাকত। একমাত্র পাকিস্তানের শাসকেরা ছিলেন তখন ‘তালেবান’–এর পাশে। এখন পাকিস্তানের ওই শাসকেরাই নিজ দেশের তালেবানকে রুখতে দর–কষাকষিতে বসতে বাধ্য হয়েছেন কাবুলে। আর তাতে মধ্যস্থতা করছে আফগান তালেবান। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপটটি এভাবে পাল্টে গেল, যা বেশ কৌতুকপ্রদ। পাশাপাশি এ প্রশ্নও উঠেছে, চলতি এ আলোচনার ভেতর দিয়ে পাকিস্তান আদৌ তালেবান সশস্ত্রতার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম কি না?

টিটিপির সঙ্গে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি

আফগান তালেবান এবং টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)–এর সবকিছু এক রকম নয়। আফগান তালেবানের মতো টিটিপির আধিপত্যের পরিসরও অত বড় নয়। পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে কেবল এই সংগঠনের সশস্ত্রতা দেখা যায়।

টিটিপিকে নিয়ে পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও সামরিক শিবিরে উপলব্ধির ফারাক আছে। রাজনীতিবিদেরা জানেন, আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন এজেন্সির গত দুই–তিন দশকের রাজনৈতিক-সামরিক নিরীক্ষার পার্শ্বফল হলো টিটিপি। এখন এ অধ্যায় থেকে বের হতে ইচ্ছুক তারা। কিন্তু ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছে।

টিটিপি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উভয়ে নিশ্চিত, আপাতত কেউ কাউকে নির্মূল করতে পারছে না। অথচ ধারাবাহিক সংঘাতে পরস্পরের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বিপুল। ‘তাতে লাভবান হচ্ছে পাকিস্তানের শত্রুরা’। এ রকম বিবেচনা থেকে এই উভয় পক্ষ সামনের দিনগুলোর জন্য এমন একটা ছক খুঁজছে, যাতে পরস্পরের দিকে বন্দুক তাক করতে না হয়। সাম্প্রতিক ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ তারই ফল।

তবে ভঙ্গুর ধাঁচের যুদ্ধবিরতির চেয়েও বেশি কিছু দরকার পাকিস্তানের। চীন-আফগানিস্তান-পাকিস্তান মিলে একটা বড় অর্থনৈতিক করিডর হয়ে উঠতে হলে টিটিপি বেইজিংয়ের জন্য অস্বস্তিকর। সে অস্বস্তির সমাধান হতে পারে টিটিপিকে কিছু ছাড় দেওয়া, যে বিষয়ে আবার পাকিস্তানে ঐকমত্যের ঘাটতি আছে। কিন্তু এ প্রশ্নে পাকিস্তানের নিয়তি হয়তো বহু আগেই নির্দিষ্ট হয়ে আছে।

টিটিপিকে নিয়ে পাকিস্তানের শাসক জোটে মতভেদ

মে-জুনজুড়ে পাকিস্তানের বিশাল এক ‘প্রতিনিধি’দলের সঙ্গে টিটিপি নেতাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে কাবুলে। টিটিপি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। তারপরও এ রকম বৈঠক হচ্ছে। আফগান তালেবানরা এ বৈঠকে মধ্যস্থতা করে যাচ্ছে। সেখানকার ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ এ সালিসের বড় অভিভাবক। পাকিস্তানের দিক থেকে এ রকম সংলাপের স্থপতি হলেন দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কিছুকাল আগের প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদ। আইএসআই থেকে সরিয়ে তাঁকে খাইবার পাখতুনখাওয়া এলাকার অ্যাকটিভ কমান্ডে নেওয়া হয়েছে, যেখানে টিটিপির জোর বেশি। ফলে এ সমস্যার সমাধানে তাঁর বিশেষ আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।

হাক্কানিদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের গুঞ্জন আছে ভূরাজনৈতিক পণ্ডিতদের মধ্যে। এই মুজাহিদিন ঘরানার এখনকার প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এ মুহূর্তে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসেবে আছেন।

আফগান তালেবান ও হাক্কানিরা তাদের সীমান্তের অপর পারে টিটিপিকে সফলই দেখতে চায়, তবে সেটা পাকিস্তানকে সন্তুষ্ট রেখে। কাবুলের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে কার কী অবস্থান, সেটা প্রকাশ্যে জানা যাচ্ছে কমই। পাকিস্তানে জনসমাজে এ নিয়ে আপত্তি উঠেছে। কেউ কেউ চাইছে, টিটিপির সঙ্গে আলোচনা পার্লামেন্টে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে হতে হবে। এ রকম মৃদু প্রতিবাদের মূলে হয়তো আইএসআইয়ে থাকাকালে জেনারেল ফয়েজ হামিদের পূর্বতন কোনো ভূমিকা।

তবে ইতিমধ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ইমরান খানকে হটিয়ে পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক জোটটি এখনÿক্ষমতায়, তাদের ভেতর টিটিপি প্রশ্নে মতবিরোধ আছে। শরিফ পরিবার এবং ভুট্টো পরিবারের টিটিপি-নীতি এক রকম নয়। বেনজির ভুট্টোর হত্যাকারী হিসেবে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সব সময় স্থানীয় তালেবানকে সন্দেহ করেছে। সুতরাং উদীয়মান টিটিপির সঙ্গে আপসে অনাগ্রহী তারা। কিন্তু শরিফরা সেনাবাহিনীর মতোই একটা আপসরফার মাধ্যমে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পক্ষে।

ফলে পাকিস্তান শিগগির টিটিপিকে নিরস্ত্র করতে পারবে বলে মনে হয় না; নির্মূল তো নয়ই। হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক কেবল আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যই নির্ধারণ করে দেয়নি, দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পাটাতনও বদলে দেওয়ার ঐতিহাসিক শর্ত তৈরি করেছে।

সরকারের তালেবান নীতিতে গোঁজামিল

পিপিপি এ সপ্তাহে টিটিপি প্রশ্নে তিন সদস্যের কমিটি করেছে। এ কমিটি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে তালেবানের বিষয়ে একক অবস্থান নিতে চায়।

সিন্ধু এবং অন্যান্য প্রদেশে পিপিপির ছোট এক সমর্থক গোষ্ঠী পশতু ও বালুচ জাতীয়তাবাদীরা। টিটিপির শক্ত ভিত পশতুদের একাংশ। এই দুই পশতু রাজনৈতিক ধারার মধ্যে ব্যবধান অনেক। পশতু জনপদে ভুট্টোদের প্রভাব বাড়াতে হলে টিটিপিকে কিছুটা কোণঠাসা করা দরকার। পশতু জাতীয়তাবাদীদের আবার সেনাবাহিনীর অপছন্দ। পশতু ও বালুচ জাতীয়তাবাদীদের রুখতেই একদা এ অঞ্চলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উৎসাহ জুগিয়েছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ‘এজেন্সি’। এখন তারা টিটিপির মতো অবাধ্য সন্তানদের থামাতে চাইছে।

শরিফ পরিবারের রাজনৈতিক ভরসা মূলত পাঞ্জাব। সেখানে টিটিপি বড় কোনো হুমকি নয়। তবে টিটিপি দেশের অন্যত্র যত শক্তিশালী হচ্ছে, পাঞ্জাবেও তালেবান আদর্শবাদের আবেদন তত বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শরিফরা অহিংস কলাকৌশলে টিটিপির অগ্রযাত্রা কমিয়ে আনার পক্ষে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের চাওয়ার মিল আছে। সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ স্বস্তিকর হয়েছে। গত পয়লা রমজান থেকে টিটিপি বসন্তকালীন যে অভিযান শুরু করেছিল, এ যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে সেটা আপাতত থামল। কেবল আড়াই মাসে টিটিপি সেনাবাহিনীর ৩০ থেকে ৪০ জন জওয়ানকে মেরেছে। এ বছরে ইতিমধ্যে ৪৬টি হামলা চালিয়ে ফেলেছে তারা। কিছু কিছু হামলা হয়েছে কথিত ‘যুদ্ধবিরতি’র মধ্যেই।

ইমরান খানের শাসনামলেও টিটিপির সঙ্গে একাধিক দফায় যুদ্ধবিরতি হয়েছে। আবার সেটা ভেঙেও গেছে। এ রকম ঘটনার কারণ, টিটিপি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের নীতিগত অবস্থানে গোঁজামিল আছে। সেই গোঁজামিলের সঙ্গে লেপটে আছে দেশটির আফগান নীতি। আফগানিস্তানের মাটিতে নিজেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে একচেটিয়া করতে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা ওই দেশের তালেবান সদস্যদের সব উপায়ে মদদ দিয়েছে। ইমরান খানের শাসনামলে তার চূড়ান্ত প্রকাশই দেখা গিয়েছিল। এখন ইসলামাবাদ থেকে আফগান তালেবানকে বলা হচ্ছে টিটিপিকে থামাও। কাজটি মোটেই সহজ নয়।

চালকের আসনে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি

টিটিপি এবং আফগান তালেবান একই আদর্শের যমজ ভাই এবং সহযোদ্ধা। বহুদিনের যুদ্ধাবস্থায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এক বন্ধু কাবুল দখলের পর অপর বন্ধু তাতে উদ্দীপনা পাবে, এটা সাধারণ কালজ্ঞানেই বোঝা যায়। পাকিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর চাপ থেকে বাঁচতে টিটিপি সদস্যদের বড় অংশ এখন আফগানিস্তানে থাকে। মধ্য এবং নিচের সারির আফগান তালেবান সদস্যদের ভালো সহানুভূতিই পায় তারা। আদর্শিক কারণেই আফগান তালেবান সদস্যরা চাইবেন পাকিস্তানেও তাঁদের বন্ধুরা বিজয়ী হোক। তবে পাকিস্তানের আপত্তির কারণে কাবুলে নীতিনির্ধারকদের পক্ষে টিটিপিকে প্রকাশ্যে আদরযত্ন করা কঠিন। আবার আফগান মাটিতে টিটিপি সদস্যদের দমাতে গেলে এরা অনেকেই চলে যাবে ‘আইএস (খোরাসান)’-এর আশ্রয়ে। তা ছাড়া সেটা আফগান তালেবানের ‘আদর্শিক বিশ্বাসঘাতকতা’ও হবে। পাকিস্তান-আফগান সীমান্তের ধরন এমন যে আফগান তালেবান চাইলেও এ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। বরং চলতি দর–কষাকষিতে টিটিপি যতটা লাভবান হবে, এ সীমান্ত বিভিন্ন দেশের ‘মুজাহিদিন’ সমাবেশ আরও বাড়বে।

সিরাজুদ্দিন হাক্কানি সে কারণেই টিটিপি এবং ইসলামাবাদকে একসঙ্গে বসিয়ে নিজের সরকারকে এ সংঘাত থেকে দূরে রাখতে চান। আফগান তালেবান এ–ও বলছে, ‘টিটিপি পাকিস্তানের বিষয়, আমরা তাতে কোনো পক্ষ নই।’ কিন্তু তারপরও আফগান তালেবান সরকার এ সমস্যা থেকে সহজে রেহাই পাবে না। যদিও তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার চেয়ে নিজেদের সমস্যার মোকাবিলায় বেশি মনোযোগ দিতে চাইছে।

আফগানরা দর–কষাকষির জন্য ভালো অস্ত্র পেয়েছে

আফগানিস্তান-পাকিস্তানজুড়ে চলাচলে থাকা টিটিপি যোদ্ধার সংখ্যা এখন প্রায় চার হাজার। কারাগারে আটকাবস্থায় আছে আরও কয়েক হাজার। পাকিস্তানের ‘নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ’ চাইছে, এরা সবাই সশস্ত্রতা ছেড়ে মূলধারার রাজনীতিতে চলে আসুক। সে জন্য আফগান সরকার তাদের ওপর চাপ দিক। কিন্তু টিটিপি নেতৃত্ব এ রকম আহ্বানকে ফাঁদ হিসেবে দেখছে।

আফগান তালেবান সদস্যদের পেছনে এত দিনকার ‘বিনিয়োগ’-এর বিনিময়ে পাকিস্তান এটা চাইতেই পারে যে ওই সীমান্ত থেকে সে কোনোভাবে গোলাগুলির শিকার হবে না। কিন্তু কাবুলে তালেবান এখন সরকার চালাচ্ছে। তাদেরও নিজস্ব কিছু রাষ্ট্রীয় অঙ্ক রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে দর–কষাকষিতে তাদেরও কিছু ‘হাতিয়ার’ দরকার। মনে হচ্ছে টিটিপি সেটা হতে পারে!

পাকিস্তানের জন্য এ পরিস্থিতি শাঁখের করাতের মতো। টিটিপিকে দমনের জন্য আফগান মাটিতে অভিযান চালাতে গেলে তাদের সেনাবাহিনী সেখানে দ্রুত অজনপ্রিয় হয়ে যাবে। পশতুরা এমনিতে পাকিস্তানে অসন্তুষ্ট জাতি। পাকিস্তানের দিক থেকে আফগানিস্তানে যেকোনো সামরিক অভিযান সেই অসন্তোষ বাড়াবে। হামিদ কারজাইসহ বহু আফগান নেতা এ ধরনের অসন্তোষ থেকে ফায়দা নিতে বসে আছেন। এত সব বেকায়দার কারণেই চার–পাঁচ হাজার যোদ্ধার একটি গেরিলা দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হলেন পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের জেনারেলরা।

টিটিপিকে নিয়ে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গভীর অস্পষ্টতাও আছে। এ কাফেলাকে রাজনৈতিক, না সামরিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে, সে বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে নেই তাঁরা। তবে টিটিপি নিজে কী চাইছে, সেটা খুব স্পষ্ট।

আফগানিস্তানের আদলে পাকিস্তানেও সরকার গড়তে চায় তারা। সেটা তাদের দূরবর্তী লক্ষ্য। আপাতত তারা খাইবার পাখতুনখাওয়ার কিছু এলাকায় শরিয়া ও ইসলামি আইনের বাস্তবায়ন চাইছে। সেনাবাহিনীর প্রাথমিকভাবে এতে আপত্তি নেই। যদিও তাতে দেশটির ওই অঞ্চলে দুই ধরনের প্রশাসন তৈরি হবে। টিটিপি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া দেখতেও অনিচ্ছুক। এটাকে তারা তুলে ধরছে পশতু জনপদের কৃত্রিম বিভক্তি আকারে। তারা আসলে এ সীমান্তে অবাধ চলাফেরার অধিকার চাইছে। পাকিস্তানের এসব ট্রাইবাল এলাকায় এখন সেনাবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। তাতে ‘জিরগা’ নামের ট্রাইবাল সরদারদের পঞ্চায়েত অখুশি। কারণ, অতীতে এসব এলাকায় একধরনের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতেন সরদারেরা। তাঁরা এখন চাইছেন টিটিপি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি হোক এবং শেষোক্তরা এলাকা ছেড়ে চলে যাক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেনাবাহিনী এলাকা ছাড়ামাত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুজাহিদিনেরা এখানে আশ্রয় পায়। টিটিপি এমন এক ছাতার মতো সংগঠন, যার মধ্যে আছে বহু উপদল। এসব উপদলের কেউ কেউ আন্তমহাদেশীয় চরিত্রের। তাদের সশস্ত্রতার পরিসর পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যেকোনো দর–কষাকষি তাদের জন্য মোটেই শেষ কথা নয়।

স্পষ্ট এক গন্তব্যের দিকে অনিশ্চিত যাত্রা

পাকিস্তানের জন্য টিটিপি সংকটের বড় ভরকেন্দ্র উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান, বান্নু প্রভৃতি এলাকা। তবে যেমনটি মনে করা হতো, এদেরÿক্ষমতা কেবল কথিত ‘মেসুদ গোত্রে’ সীমিত নয়। তা ছাড়া টিটিপির বাইরেও আরও কিছু সংগঠন পাকিস্তানে কর্তৃপক্ষের উদ্বেগের কারণ হয়েছে। যার মধ্যে আছে টিএলপি (তেহরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান)। টিটিপির মতো সশস্ত্র না হলেও টিএলপি আদর্শিকভাবে তাদের অনেক কাছাকাছি। সমাবেশ শক্তিতেও টিএলপি অনেক শক্তপোক্ত। পাঞ্জাবে তাদের প্রবল উপস্থিতি দেশটির কুলীনদের জানিয়ে দিচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোর অনিবার্য রদবদলের কথা। এসব সংগঠন পাকিস্তানের সমাজজীবনে ধর্মীয় প্রভাবের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে এখন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক পরিসরের দিকে এগোচ্ছে। জাতীয় অনেক বিষয়ের মতো আসন্ন এ সুনামি নিয়ে পাকিস্তানের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো ঐকমত্য নেই। আপাতত সেটা হওয়াও সম্ভব নয়। ইমরান খান, শরিফ পরিবার এবং ভুট্টো পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস প্রবল। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সামরিক আমলাতন্ত্রের রয়েছে অবিশ্বাসে ভরা এক সম্পর্ক। এ রকম টানাপোড়েনের ভেতর এক জোট হয়ে সশস্ত্র ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে কোনো একক অবস্থান তৈরি সহজ নয়। তা ছাড়া এসব দলের স্পষ্ট সামাজিক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

ফলে পাকিস্তান শিগগির টিটিপিকে নিরস্ত্র করতে পারবে বলে মনে হয় না; নির্মূল তো নয়ই। হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক কেবল আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যই নির্ধারণ করে দেয়নি, দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পাটাতনও বদলে দেওয়ার ঐতিহাসিক শর্ত তৈরি করেছে।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক