ভারত ও চীনের সঙ্গে নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। নেপালের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিতে (এনসিপি) কোন্দল অনেক দিনের। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সুপারিশে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারি। তাঁর এই সিদ্ধান্ত গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। ধরে নেওয়া যায়, সামনেই নেপালে নতুন নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে নতুন মাত্রা এসেছে।
এনসিপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় নেপালের। তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা শীতলতা আসে। সম্প্রতি ভারতের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজনের সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কে আবারও উষ্ণতা এসেছে।
গত বছরের ২১ থেকে ২২ অক্টোবর ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের প্রধান সামন্ত গোয়েল নেপাল সফর করেন। গত ৪ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ এম এম নারাভানে দ্বিতীয়বার নেপালে সফর করেন। সীমান্ত ও মানচিত্র নিয়ে নেপালের সঙ্গে ভারতের শীতল সম্পর্ক প্রথম সফরে উষ্ণ হয়। দ্বিতীয় সফরে দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহ্যগত সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
নেপালের সেনাবাহিনী থেকে নারাভানেকে ‘মহারথী’ উপাধি দেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নেপালের বিভিন্ন হাসপাতালে নারাভানে চিকিৎসা সরঞ্জামও সরবরাহ করেছেন।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা নেপালে তৃতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে সফর করেন। এ সফরে সীমান্ত বিরোধের ইস্যুগুলো সমাধানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ভূমিকম্প–পরবর্তী পুনর্নির্মাণ কর্মসূচিতে ভারত সহায়তা দেওয়ার কথা জানায়।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে নেপাল ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হয়েছে। নেপালের বেশ কয়েকটি বহুমুখী প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে ভারত। দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত সহজ করা ও ভারতের পক্ষ থেকে নেপালকে টিকা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
বসে নেই চীনও। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর ওয়ে ফেনঘে নেপাল সফর করেছেন গত বছর। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সফরের সঙ্গে তাঁর সফরের ব্যবধান ছিল দুই দিনের।
২০০৮ সালে নেপালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে চীন নেপালের রাজনীতি ও সমাজকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালে এনসিপি, মাওবাদী দল ও ইউএমএলকে চীন এক করেছে। তবে পরে আবার বিরোধ দেখা গেছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক চন্দ্র দেব ভট্ট
শ্রিংলা তাঁর সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের পক্ষ থেকে যৌথ কমিশনের বৈঠক হবে বলে আভাস দেন।অন্যদিকে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরকালে দেশটির সরকারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতাধীন ট্রান্স-হিমালয়ান বিলাসবহুল প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সফরকালে চীন যথেষ্ট সমাদরও পেয়েছে নেপালের কাছে। নেপালের সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও কাউন্সিলর ওয়েকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কাঠমান্ডুতে চীনের সামরিক সহায়তা আবার চালু করার কথাও বলা হয়। নেপালের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সন্তোষ বল্লভ পাওদেয়াল বলেন, ২০১৯ সালে নেপালের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঈশ্বর পোখায়েরেলের বেইজিং সফরকালে ২৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ চুক্তি আবার কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে।
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এক দিনের সফর নিয়ে বেইজিং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু জানায়নি। তবে চীন ও নেপালের সম্পর্কের উন্নয়ন হবে—এমন আভাস পাওয়া গেছে। আর ভারতের সফরে সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস আরও স্পষ্ট।
ভারত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় নেপালের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। হিন্দুস্তান টাইমসের খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী অলির সুপারিশে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারি পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন অলি। এনসিপির সঙ্গে, বিশেষ করে সাবেক মাওবাদী বিদ্রোহী নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে অলি পার্লামেন্টে ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেন। এনসিপির কো–চেয়ার পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে অলির।
নেপালের রাজনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অলি এনসিপির প্রচণ্ডকে দায়ী করেন। স্থানীয় সময় ৩ জানুয়ারি অলি বলেন, রাজনৈতিক চাপের কারণেই তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিটিআইয়ের খবরে জানা যায়, অলি আইনপ্রণেতাদের বলেছেন, তিনি নতুন নির্বাচন চান।
অলি বরাবর অভিযোগ করেছেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভারতের ইন্ধন রয়েছে। নেপালের পার্লামেন্টে দেশটির নতুন মানচিত্র অনুমোদন দেওয়াকে কেন্দ্র করে অলির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় ভারতের। ভারতবিরোধী মনোভাবকে পুঁজি করে সে সময় জনপ্রিয়তাও পান অলি। তবে অলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ ও নতুন নির্বাচনের ডাক দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নেপাল এবং তাদের জনগণকে সমর্থন দিয়ে যাবে ভারত।
চীনা কর্মকর্তারা সীমান্ত অবকাঠামো ও যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছেন। চীনের কোটি কোটি ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলো নেপাল। নেপালকে নিয়ে আন্তর্জাতিক তৎপরতা বাড়াতে চায় বেইজিং। কাঠমান্ডু পোস্টের এক খবর বলছে, এনসিপির মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়েছে চীন। অলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগও আটকাতে চেয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা নেপালে তৃতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে সফর করেন। এ সফরে সীমান্ত বিরোধের ইস্যুগুলো সমাধানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ভূমিকম্প–পরবর্তী পুনর্নির্মাণ কর্মসূচিতে ভারত সহায়তা দেওয়ার কথা জানায়।
গত বছরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এবং মে মাসের শুরুতে নেপালে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকি অলিসহ এনসিপি নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন। প্রচণ্ড এবং জ্যেষ্ঠ নেতা মাধব নেপালের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তখন কিছুটা ঐকমত্য হলেও দুই মাস পর প্রচণ্ড আবার অলির পদত্যাগ দাবি করেন। এসব থেকে বোঝা যায়, অলিকে সমর্থন করে চীন। বেইজিং প্রচণ্ডর চেয়ে অলিকে বেশি সমর্থন দিচ্ছে।
কাঠমান্ডুভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক চন্দ্র দেব ভট্ট দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ২০০৮ সালে নেপালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে চীন নেপালের রাজনীতি ও সমাজকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালে এনসিপি, মাওবাদী দল ও ইউএমএলকে চীন এক করেছে। তবে পরে আবার বিরোধ দেখা গেছে।
প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে নেপাল সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। নেপাল দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী ট্রানজিট হিসেবে কাজ করতে পারে। নিজের পরিচয়ও প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তবে সেটা করতে হলে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। নেপালের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত ভারত ও চীনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তবে প্রতিযোগিতার মধ্যে না গিয়ে নেপালের অর্থনৈতিক ও গঠনমূলক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। নেপালকে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করতে হবে। ভারত ও চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। এই সম্পর্ক গতিশীল ও সহযোগিতার ভিত্তিতে স্থাপন করতে হবে। (অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, দ্য ডিপ্লোম্যাট, হিন্দুস্তান টাইমস, পিটিআই ও নিকে এশিয়া অবলম্বনে)