সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান ১৩ মে মারা যান। মৃত্যুকালে আবুধাবির এই শাসকের বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
শেখ খলিফার মৃত্যুর পর দেশটিতে ৪০ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাৎক্ষণিকভাবে শোক প্রকাশ করেন।
শেখ খলিফাকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সত্যিকারের অংশীদার ও বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে আরও জোরদার করার মাধ্যমে শেখ খলিফার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর অঙ্গীকার করেন বাইডেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সদ্য প্রয়াত শেখ খলিফার ভূয়সী প্রশংসা করেন। রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি গঠনমূলক সহযোগিতা জোরদারে শেখ খলিফা অনেক কিছু করেছেন বলে উল্লেখ করেন পুতিন।
শেখ খলিফা বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন, যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির মুখ উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো কোর্টনি ফ্রিয়ার বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের উন্নয়নে শেখ খলিফার ভূমিকা সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
২০১৪ সালে শেখ খলিফা স্ট্রোক করেন। তারপর তাঁর ভাই শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স হন। ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর কার্যত শেখ মোহাম্মদই দেশ চালাচ্ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ‘ডি-ফ্যাক্টো’ শাসক।
শেখ খলিফার মৃত্যুর এক দিন পর ১৪ মে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন শেখ মোহাম্মদ। ‘এমবিজেড’ নামে পরিচিত শেখ মোহাম্মদ আবুধাবির শাসকের দায়িত্বও পালন করছেন।
শেখ খলিফার চিরবিদায়ের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি আনুষ্ঠানিক প্রজন্মগত পরিবর্তন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।
শেখ মোহাম্মদের আমল কেমন হবে, সে প্রসঙ্গে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো কোর্টনি ফ্রিয়ার বলেন, ‘এমন কিছু জল্পনা রয়েছে যে আবুধাবিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমবর্ধমানভাবে কেন্দ্রীভূত হতে পারে। অবশ্য আমি বলব, এ প্রবণতা অন্তত ২০১৪ সাল থেকেই চলে আসছে।’
কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগও মনে করেন, নতুন নতুন প্রেসিডেন্টের সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বদলে আরও কেন্দ্রীকরণ দেখা যেতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আবুধাবির পরবর্তী ক্রাউন প্রিন্স কে হবেন।
এ ক্ষেত্রে দুটি নাম শোনা যায়। প্রথমজন হলেন শেখ খালেদ বিন মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান। তিনি আবুধাবি এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। আবুধাবি এক্সিকিউটিভ অফিসের চেয়ারম্যান।
দ্বিতীয়জন হলেন তাহনাউন বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তাঁকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়।
আবুধাবিতে খালেদ ও তাহনাউন উভয়ই খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিংস কলেজ লন্ডনের আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেন, এ দুজনের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার জন্য একটা অভ্যন্তরীণ লড়াই চলে আসছে। তবে ক্ষমতা ও নিজস্ব নেটওয়ার্ক বিবেচনায় আবুধাবির পরবর্তী ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে তাহনাউনের সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে।
শেখ মোহাম্মদ কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, সেটিও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ মোহাম্মদ। তিনি সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ। তিনি ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। তিনি ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ফলে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তাঁকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যেতে পারে।
শেখ মোহাম্মদের শাসনামলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থিতিশীলতার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন পর্যন্ত একটি সমৃদ্ধ ফেডারেশন হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। শেখ মোহাম্মদ কীভাবে তাঁর দেশকে একক রাষ্ট্রে রূপান্তরের পদক্ষেপ নেন, তা দেখার বিষয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে শেখ মোহাম্মদ তাঁর দেশের জন্য একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ভবিষ্যৎমুখী পদ্ধতি গ্রহণের বিষয়টি অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি জোরদার করার কথা বলেছেন।
দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম বলেছেন, শেখ মোহাম্মদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ একটি নতুন ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করেছে। পাশাপাশি একটি দেশের নতুন জন্মের জানান দিচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব বৈশ্বিক সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে উন্মুখ।
নতুন যুগটি কেমন হবে, তার একটি বিবরণ দিয়েছেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেছেন, এ পর্যায় গড়ে তোলা হবে অতীতের অর্জনের ওপর ভিত্তি করে। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা হবে। অর্থনীতি টেকসই করা হবে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে, সে সম্পর্কে ভাইস প্রেসিডেন্টের ভাষ্য, একটি সক্রিয় ও ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে, যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
আল-জাজিরা, এএফপি ও আমিরাত নিউজ এজেন্সি অবলম্বনে