মোহাম্মদ বিন সালমানের আনুষ্ঠানিক পদ উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কিন্তু তিনিই সৌদি আরবের সর্বেসর্বা। বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ নন, সৌদি আরব চালান তাঁর ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি আরবের ‘কার্যত শাসকের’ তকমা দিয়েছে।
নিছক তকমা নয়, প্রকৃত অর্থেই কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ৩৫ বছর বয়সী এই যুবরাজ। ৮৫ বছর বয়সী বাদশা সালমানকে জনসমক্ষে খুব কমই দেখা যায়। তাঁর স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ আছে। এ অবস্থায় বাদশার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই সামলাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও তিনিই সৌদি আরবকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
২০১৫ সালে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদির সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন বাদশাহ সালমান। শুরুতেই নানান সাহসী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি সাড়া ফেলে দেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে ইতিবাচক খবর প্রকাশ করে। কিন্তু অচিরেই তাঁর আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। ইয়েমেনে সৌদি জোটের আগ্রাসী সামরিক অভিযানের রূপকার তিনি। জবরদস্তিমূলক এই হামলায় ইয়েমেনে শুধু রক্তই ঝরেনি, দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বাজে মানবসৃষ্ট মানবিক সংকটে রয়েছে। ২০১৭ সালে কাতারকে একঘরে করে শায়েস্তা করার মূল কারিগরও মোহাম্মদ বিন সালমান।
নারী অধিকারকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচকদের দমন-পীড়নসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অল্প সময়েই দুর্নাম কুড়ান মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি সবচেয়ে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেন সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনায়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় যুবরাজের এই কট্টর সমালোচককে। এই হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম উঠে আসে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নে। তবে সৌদির যুবরাজ এই হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসছেন।
গুরুতর সব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ বিন সালমান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছিলেন। সৌদির যুবরাজের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমালোচনামুখর হলেও ট্রাম্প ছিলেন চুপ। বলা যায়, তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানকে অনেকটা ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ বিন সালমানকে রক্ষায় নেপথ্যে কাজ করে আসছিলেন ট্রাম্পের জামাতা ও তৎকালীন উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার। কারণ, কুশনারের সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমানের গভীর ভাব রয়েছে।
জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মোহাম্মদ বিন সালমানের কপালে চিন্তায় ভাঁজ পড়ে। কেননা, বাইডেন আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড বন্ধ করবেন। বিশ্লেষকেরাও বলছিলেন, ট্রাম্পের আমলে মোহাম্মদ বিন সালমান যে দায়মুক্তি পেয়ে এসেছেন, বাইডেনের আমলে তা তিনি আর পাবেন না।
বাইডেনের শপথ নেওয়ার আগের ঘটনা। কয়েক মাসের নীরবতা শেষে হঠাৎ নড়েচড়ে বসেন মোহাম্মদ বিন সালমান। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তিনি আবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। উদ্দেশ্য—বাইডেনকে নিজের গুরুত্ব বোঝানো। তবে মোহাম্মদ বিন সালমানের সেই প্রচেষ্টা কাজে আসেনি বলেই মনে হচ্ছে। তিনি একটা ধাক্কা খেয়েছেন।
২০ জানুয়ারি বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি সৌদির ‘কার্যত শাসক’ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, মোহাম্মদ বিন সালমানকে ফোন করার কোনো পরিকল্পনা বাইডেনের নেই।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকিকে প্রশ্ন করা হয়, সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কথা বলবেন কি না। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জেন সাকি স্পষ্ট করে বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমমর্যাদার ব্যক্তি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নন। বাইডেনের সমমর্যাদার ব্যক্তি বাদশাহ সালমান। আর যথাসময়ে এই দুই নেতার মধ্যে কথা হবে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যতই ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোন না কেন, তাঁকে বাইডেন প্রশাসন ঠিক কোন চোখে দেখছে, মূলত তার আভাস দিলেন জেন সাকি।
সৌদি আরব বিষয়ে আগ্রহী লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক বিল বস্টক এই ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, মোহাম্মদ বিন সালমানের স্ট্যাটাস যে নিচে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাইডেনের হোয়াইট হাউস।
মোহাম্মদ বিন সালমানের যে পদ, সে অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সমমর্যাদার ব্যক্তি দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে বাইডেনের সঙ্গে মোহাম্মদ বিন সালমান যান না।
মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘বাড়াবাড়ি’ ঠেকাতে বাইডেনের ওপর চাপ রয়েছে। সম্প্রতি বাইডেন তাঁর পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণায় মোহাম্মদ বিন সালমানের লাগাম টানার বিষয়ে পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়। মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ইয়েমেনে চলা যুদ্ধে সৌদিকে মার্কিন সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেন বাইডেন। তা ছাড়া তিনি জানিয়ে দেন, তাঁর প্রশাসনের কূটনীতির কেন্দ্রে থাকবে মানবাধিকার। ইতিমধ্যে বাইডেনের নেওয়া পদক্ষেপে চাপে আছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি প্রকাশ করতে প্রস্তুত বাইডেন প্রশাসন। এই নথি প্রকাশ পেলে মোহাম্মদ বিন সালমান আরও চাপে পড়বেন।