ব্যাংকার লি জু-হি। কাজ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ব্যাংকে। অফিসে তাঁর ছোট্ট টেবিলটি যেন ছোট্ট গোলাপি রাজ্য। টেবিলের প্রায় সবই গোলাপি রঙের। এই ‘জগতে’ আছে ছোট্ট পাখা, বাতাস বিশুদ্ধ করার যন্ত্র। আছে ঘর উষ্ণ রাখার ছোট যন্ত্রও। তাঁর কি-বোর্ডটিও গোলাপি রঙের।
৩৫ বছর বয়সী লি বলছিলেন, ‘আমি এখানে কাজ করছি বছর ছয়েক ধরে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমি টেবিল সাজানোর কাজ করছি। প্রতি মাসে এর পেছনে খরচ হয় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ওন (২৫ থেকে ৩৩ ডলার)। কখনো কখনো তা দেড় লাখ ওন ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থ খুব বেশি নয়। কিন্তু এসব চমৎকার জিনিস মন ভালো করে দেয়।’
সবার ভাবনায় ব্যাংকারের টেবিলের যে চিত্র গেঁথে থাকে, তা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন লির টেবিল। শুধু লি নন, তাঁর মতো অনেকেই এখন নিজের মনের মতো করে টেবিল সাজাচ্ছেন। যাকে বলা হচ্ছে ‘ডেস্কটেরিয়র’। দীর্ঘ কর্মঘণ্টায় অফিসে কিছুটা বাড়ির আবহ দিতেই টেবিল সাজানোর এই উদ্যোগ তাঁদের।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে কোরীয় সরকার সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৬৮ থেকে নামিয়ে ৫২ ঘণ্টা নির্ধারণ করে। কিন্তু দেশটির অনেক তরুণ-তরুণী এখনো দীর্ঘ সময় অফিসে থাকছেন। লির কথায়, ‘ঘুমের বাইরে বড় একটা সময় আমার অফিসে কাটে। আপনার মনে হতে পারে, অফিস একটি নিরানন্দ ও কঠিন জায়গা। কিন্তু আমার গোলাপি রঙে রাঙানো অফিস আমাকে কর্মস্পৃহা জোগায়। কারণ, এতে কাজের চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গোলাপি রঙের এসব জিনিসপত্র আমাকে স্বস্তি দেয়, আনন্দ দেয়।’
ডেস্ক ও ইন্টেরিয়র শব্দ যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে ‘ডেস্কটেরিয়র’ শব্দটি। দক্ষিণ কোরিয়ায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শব্দটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অনলাইনে চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইট জব কোরিয়া ২০১৭ সালে ৭৮৮ জন কর্মজীবীর ওপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, ৪৪ শতাংশ নারী ও ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ ডেস্কটেরিয়র চর্চা করেছেন। জরিপ অনুযায়ী, ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ কোরীয় নাগরিক তাঁদের কর্মক্ষেত্রের টেবিল সাজাতে আগ্রহী। তরুণদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি।
সিউলের বিক্রয় ব্যবস্থাপক রাহ হাই-ইয়ং। হলিউডের সিনেমার চরিত্রদের আদলে নিজের টেবিল সাজিয়েছেন তিনি। ৩০ বছর বয়সী এই নারী বলছিলেন, ‘যখনই আমি নতুন কোনো অ্যাকশন ফিগার দেখি, তা আমি অফিসে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিই না। কারণ, বাড়ি থেকে আমাকে অফিসেই বেশি সময় থাকতে হয়।’ তাঁর বক্তব্য, ডেস্কটেরিয়র শুধু দৃষ্টিনন্দন কর্মক্ষেত্র দেয় না, এটি তাঁকে আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সহায়তা করে।
রাহ হাই-ইয়ং আরও বলেন, ‘কাজের সময় মনে হয়, আমি বাসায় আছি। নতুন নতুন পণ্য খোঁজা ও সেগুলো ক্রেতাদের কাছে হাজির করাই আমার কাজ। তাই আমাকে সৃজনশীল হতে হবে। রঙিন টেবিল আমাকে সৃজনশীল চিন্তায় সাহায্য করে।’
দক্ষিণ কোরিয়ায় ডেস্কটেরিয়রের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নতুন বাজার। সেখানে আসছে নতুন নতুন পণ্য। চাহিদা বাড়ছে তারহীন কি-বোর্ড, ল্যাপটপ স্ট্যান্ড, রঙিন ডেস্ক ম্যাট, কুশন, ছোট গাছ ও এয়ার ফ্রেশনারসহ নানা জিনিসের।
কঠোর পরিশ্রমের জন্য সুখ্যাতি আছে দক্ষিণ কোরীয়দের। একজন কোরীয় বছরে গড়ে ২ হাজার ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন, যা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় ২৭৮ ঘণ্টা বেশি।
সাংসিন উইমেন্স ইউনিভার্সিটির নকশা প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লি হ্যাং-ইউন ডেস্কটেরিয়রকে চাপ কমানো ও অফিসকে আরও আরামদায়ক করার পন্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, কর্মপরিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। কর্মজীবনের ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। একঘেয়ে দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে নিজস্ব একটি জগৎ তৈরির আকাঙ্ক্ষা থেকে ডেস্কটেরিয়রের ধারণা এসেছে বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, এ থেকে এটি পরিষ্কার যে কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চান তরুণেরা।
তবে সব প্রজন্মের মানুষ এই প্রবণতার সঙ্গে একমত নন। যেমন: লি জু-হির অফিসের বস। পঞ্চাশের ঘরে পা দেওয়া এই ব্যক্তির মতে, ব্যাংকের মতো আর্থিক খাতের অফিসে লির এই সাজসজ্জা ‘বাড়াবাড়ি’।