আফগানিস্তানে তালেবানের আকস্মিক ক্ষমতা দখলে দেশজুড়ে জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। সম্প্রতি একজন সাংবাদিক আফগানদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। সেখানে একটি প্রশ্ন ছিল তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে ও পরে তাঁদের চাকরির অবস্থা নিয়ে। পুরোপুরি পরিবর্তিত জীবনব্যবস্থায় আফগানরা কীভাবে লড়াই করছেন, সেই চিত্র উঠে এসেছে অনেকের উত্তরে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি আফগানিস্তানের কয়েকজন কর্মকর্তা ও মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের মুখের সেই বয়ান তুলে ধরা হলো—
তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে আহমেদ আফগানিস্তানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক পদে কাজ করতেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। বিবিসিকে আহমেদ বলেন, ‘ওই সময়টা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, আমি কাজে ছিলাম এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বোনকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারতাম। আমার ভালো বেতন ছিল, যা পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। তখন অর্থ সঞ্চয় করতাম পাশাপাশি অর্থ বাড়িতে পাঠাতাম।’
আহমেদ আরও বলেন, ‘অফিসে আমার অনেক বন্ধু ছিল। তাঁরা সবাই তাঁদের চাকরি হারিয়ে এখন বেকার। কিন্তু এখন আমার জন্য জীবনটা অনেক কষ্টের। বিশেষ করে আমার পরিবারের জন্য। কারণ, এখানে কোনো কাজ নেই, পরিবার চালানোর জন্য আয়ের কোনো উৎস নেই।’
আহমেদ মা-বাবার একমাত্র ছেলে। পরিবারের সবার বড়। তাঁর বাবার বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি। বয়স ও শারীরিক জটিলতার কারণে তিনি কাজ করতে পারেন না। এ বিষয়ে আহমেদ বলেন, ‘পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় আমার ওপর দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রতিদিন পণ্যের দাম বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভোগের।’
তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেন জাহরা। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি আর শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পারেননি। ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমি যখন মেডিকেলের ছাত্রী ছিলাম, তখন আমার জীবনের সেরা সময় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণে আমি দুই বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। এটার অনেক মূল্য ছিল। এটার জন্য আমি অনেক চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু শূন্য হাতে ফিরে এলাম। এটা আমাকে অনেক বেশি মর্মাহত করেছে।’
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একরাশ হতাশা প্রকাশ করে জাহরা বলেছেন, ‘আজকের জীবন কোনো জীবন নয়। কোনো লক্ষ্য ছাড়া শুধু টিকে থাকা ও শ্বাস নেওয়া। এটা কোনো জীবন নয়। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন স্বপ্ন দেখতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। আমি বন্ধুদের সঙ্গে পড়তে ভালোবাসতাম। আমি সত্যিই সেই জীবনকে ভীষণ মিস করছি।’
জাহরা আরও বলেন, ‘আমার বেশির ভাগ সময় কাটছে বাড়িতে বসে বসে। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া আমি যে বাইরে যেতে পারতাম, সেটা চরম মিস করছি। আমি এখন বাড়িতেই ইংরেজি শিখছি, বই পড়ে অনেক নতুন কিছু জানার চেষ্টা করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক।’ তবে আশা ছাড়ছেন না জাহরা। একদিন পরিস্থিতি ঠিক হবে, আবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস করতে পারবেন, এমন আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সানা আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তালেবান ক্ষমতায় আসার আগেও আমরা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। কিন্তু তখন আমরা ভালোই ছিলাম। কারণ, তখনো কিছু ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল। আমরা পড়তে পারতাম, কাজে যেতে পারতাম, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে পারতাম। একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে পারতাম, বিতর্ক করতে পারতাম। একই সঙ্গে আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে খুশি ছিলাম। আমরা আইন (নারী অধিকারবিষয়ক) পরিবর্তনের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। আমরা আমাদের মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম।’
সানা বর্তমানে ইরানে আছেন। তিনি জার্মানির ভিসা পেয়েছেন। তালেবানের আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়াকে দুঃস্বপ্ন মনে করেন সানা। তিনি বলেন, ‘আমরা সংগ্রাম করে যতটুকু অর্জন করেছিলাম, সেটা হারানো আমার জন্য দারুণ কষ্টের। আমি শারীরিকভাবে বেঁচে আছি। আমি আমার পরিবার ও জন্মস্থানকে মিস করি। আমি আমার প্রতিবেশী, ভাষা—সবকিছুই মিস করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু আমার হৃদয় পড়ে রয়েছে সেখানে। এটা আমাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে।’
সাইদ সাংবাদিকতা করতেন। আফগানিস্তানের বৃহত্তম সম্প্রচারমাধ্যমের উপস্থাপক ছিলেন তিনি। সাইদ এখন যুক্তরাষ্ট্রে। শরণার্থী হিসেবে দেশটিতে আশ্রয়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু তাঁর পরিবার আফগানিস্তানেই রয়ে গেছেন।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সাইদ বলেছেন, ‘আমি আমার পেশাজীবন মিস করি। এই পেশা ঘিরেই আমার সব স্বপ্ন ছিল। এখনকার অবস্থা মনে উঠলে নিজেকে চরম বিধ্বস্ত লাগে।’
তালেবান যেদিন (১৫ আগস্ট) ক্ষমতা দখল করে, সেদিনও সাইদ কর্মরত ছিলেন। কিন্তু বিকেলের মধ্যে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে সাইদ বলেন, ‘আমাদের অফিস প্রায় খালি হয়ে গেল। সব নারী সহকর্মী অফিস ছাড়লেন। আমাদের কারিগরি সহায়তা দল দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করলেন। যে পোশাক সাধারণ মানুষ পরে, সেটা পরলেন তাঁরা।’
আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সাইদ বলেন, ‘২০ বছরের অগ্রগতি ও আত্মোৎসর্গ তছনছ হয়ে গেছে এবং ধ্বংস হয়ে গেছে আমার আশা, স্বপ্ন—সবকিছু। কিন্তু সবকিছুর পতন ঘটে হঠাৎ করেই। আমি এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারি না।’ পরিবার-পরিজন থেকে দূর থাকার কষ্টের কথা উল্লেখ করে সাইদ বলেন, ‘পুরোপুরি ভিন্ন পরিবেশ থাকা প্রিয়জনেরা দূরে থাকায় আমার জীবন অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছে।’
ভাষান্তর করেছেন কামরুজ্জামান