ইন্দোনেশিয়া নির্বাচন

জয়ের জন্য ভুল পথে

১৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও আঞ্চলিক নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
১৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও আঞ্চলিক নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ অনেক বেশি, সে অনুযায়ী ভোট দেওয়ার হার কম। ভারতে ভোটাররা বেশ সচেতন, সংখ্যাতেও অনেক বেশি। তবে বড় দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সাত ধাপে কয়েক সপ্তাহ ধরে ভোট নেওয়া হচ্ছে। ভারতের মতো আরেকটি বেশি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া। ২৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও আঞ্চলিক অ্যাসেম্বলি বেছে নিতে ১৭ এপ্রিল ভোট হয়েছে। এভাবে এক দিনে ভোট নিয়ে নতুনভাবে ইতিহাস রচনা করল ইন্দোনেশিয়া।

ভোটের দিন ভোট শেষে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া গেলেও আগামী মে মাসে নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করবে। তবে প্রাথমিক ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো।

প্রথমবারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ও আঞ্চলিক নির্বাচন একসঙ্গে সম্পন্ন হলো। অন্তত ১৯ কোটি ভোটারের অংশগ্রহণে ইন্দোনেশিয়ার এক দিনের নির্বাচনটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এবং জটিলতম নির্বাচনের খাতায় নাম লিখিয়েছে। প্রায় ২০ হাজার স্থানীয় ও জাতীয় আসনের বিপরীতে ২ লাখ ৪৫ হাজারেরও বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় বিষয় এতই আলোচিত ছিল যে ইন্দোনেশিয়ার এই নির্বাচন ঘিরে আগ্রহী ছিল সারা বিশ্ব।

২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন জোকো উইদোদো বা জোকোয়ি মুখোমুখি হন তিন তারকাধারী জেনারেল প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তোর। এবারও সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। দেশটিতে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রক্ষণশীল ইসলাম ধর্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক চাল নির্ধারণ করেন দুজনই।

নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো। ছবি: রয়টার্স

বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকোয়ি একসময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। মাঝারি আকৃতির একটি শহরের মেয়র ছিলেন। দরিদ্র ইন্দোনেশীয়দের ভাগ্য উন্নয়নে তিনি কঠোর শ্রম দিয়েছেন। জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা স্কিম করেছেন, শিক্ষা খাত ও ভেঙে পড়া অবকাঠামো প্রকল্পগুলোয় অর্থ ঢেলেছেন। যদিও উন্নয়নে আলোকপাত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও জোকোয়ি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করতে পারেননি।

নির্বাচনে জোকোয়ির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাবোয়ো ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসক (১৯৬৭-১৯৯৮) সুহার্তোর জামাতা। প্রাবোয়ো ইন্দোনেশিয়াকে আবারও মহান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি ইসলামি মৌলবাদীদের আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোকোয়িকে খ্রিষ্টান বা কমিউনিস্টদের ঘনিষ্ঠ উল্লেখ করে ছড়িয়ে পড়া গুজবকে পুঁজি করে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এটা ছিল বিপজ্জনক খেলা।

নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, জোকোয়ি এগিয়ে রয়েছেন। তবে এ থেকে মনে করার কোনো কারণ নেই যে ইন্দোনেশিয়ায় সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে যায়—এমন কোনো ব্যাপারে নাগরিকদের তিনি স্বাধীনতা দেন না। গত বছর তাঁর বিরোধীদের ‘প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন কর’ আন্দোলনের অনেক সমাবেশ অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

স্ত্রীর সঙ্গে ভোট দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ছবি: রয়টার্স

ইন্দোনেশীয়দের সামনে প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার অনেক সুযোগ থাকলে হয়তো তাঁরা প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। জোকোয়ির পার্টি পিডিআইপি এবং রাজনীতির অন্য শক্তিগুলোর গোপন আঁতাতে দেশটির জনগণের সে সুযোগ কমে গেছে। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে হলে ওই প্রার্থীকে এমন দল বা জোটের সমর্থন থাকতে হবে, পার্লামেন্টে যাদের এক-পঞ্চমাংশ আসন রয়েছে। এই নিয়মে পড়ে প্রেসিডেন্ট জোকোয়ির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার একমাত্র সুযোগ পেয়েছেন প্রাবোয়ো।

কার্যত, দেশটিতে দুটো মতাদর্শ রয়েছে। এক পক্ষ ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্য পক্ষ যারা মনে করে জনজীবনে ইসলামই পারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে। এ ক্ষেত্রে জোকোয়ির রেকর্ড হতাশাজনক। জাকার্তার গভর্নর বাসুকি তিজাহাজা পুরনামা, আহোক নামে যিনি অধিক পরিচিত, তাঁকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে হেনস্তা করলেও জোকোয়ি তাঁকে রক্ষা করেননি। অথচ আহোক ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক মিত্র। উল্টো তিনি নিজেকে ধর্মপরায়ণ হিসেবে হাজির করেন, আহোকের বিচার দাবিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। এমনকি এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানে জোকোয়ি এমন একজন ইমামকে বেছে নেন, যিনি আদালতে আহোকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

জোকোয়ি ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি প্রশাসনকে একটি চরমপন্থী গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করতে ও অন্যদের ছুড়ে ফেলতে ব্যবহার করেছেন। তিনি হেভি মেটাল গানের ভক্ত। তাঁর স্ত্রী হিজাব পরেন না। তাঁর দল সংখ্যালঘুদের কাছে প্রিয়। তবে নির্বাচনে এগিয়ে থাকার পরও তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নন যে ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। জোকোয়ির মেয়াদের সময়ে সংখ্যালঘু মতাদর্শের ব্যক্তিরা যে শিক্ষা নিয়েছেন, তা হচ্ছে গালিগালাজ আর হুমকির মধ্যে দিয়েই তাঁদের নিজেদের পথ করে নিতে হবে। দেশটির বড় একটি অংশ ধার্মিকতা ও অসহিষ্ণুতার মর্ম বুঝে গেছে। তাই তাদের ভোটেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। উদারপন্থী দল হিসেবে পিডিআইপিকে পছন্দ করে নিয়েছে তারা। তবে তাদের এই সংযম ও মধ্যপন্থা গ্রহণ কোনো কাজে দেবে না যদি জোকোয়ির সঙ্গে নতুন করে শুরু করা রাজনীতিকেরা ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘদিনের সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের পক্ষে দাঁড়াতে আগ্রহী না হন।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট , বিবিসি অনলাইন