পবিত্র জেরুজালেম শহরকে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একতরফা এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘ, আরব ও মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ, এমনকি মার্কিন মিত্রদের আপত্তিও মানেননি। নিজের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তেই অনড় রইলেন।
বাংলাদেশ সময় গতকাল বুধবার রাত সোয়া ১২টার দিকে ট্রাম্প বিতর্কিত এ ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ইসরায়েলের তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এই ঘোষণায় তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে না। জাতিসংঘ বলেছে, ফিলিস্তিন সংকটে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। আর ট্রাম্পের ঘোষণা ‘নরকের দরজা’ খুলে দিল বলে মন্তব্য করেছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তবে একে ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ বলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল বরাবরই জেরুজালেমকে তার রাজধানী দাবি করে আসছিল। ফিলিস্তিনও তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে এ শহরকে বিবেচনা করে।
গতকাল হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। তিনি তাঁর এমন উদ্যোগকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা পদক্ষেপ’ বলেও মন্তব্য করেন।
ভাষণে ট্রাম্পে আরও বলেন, ‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ে মানলে’ ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন জানাবে যুক্তরাষ্ট্র। তাঁর এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একজন মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে বলেন, এ রকম সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে ‘বিপজ্জনক ফল’ বয়ে আনবে।
* ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাখোঁর
* হামাস বলেছে, এ সিদ্ধান্ত ‘নরকের দরজা’ খুলে দিল
ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তম স্বার্থ এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরকে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টরা এই দুই স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো বিতর্কিত পদক্ষেপ নেননি। বহু দশক ধরে মার্কিন নীতি ছিল সমঝোতার মাধ্যমে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের সুরাহা। কিন্তু ট্রাম্প পূর্বসূরিদের সেই ধারাবাহিকতা থেকে সরে এলেন। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ সিদ্ধান্ত সেই প্রতিশ্রুতিরই বাস্তবায়ন বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাতে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়বে এবং এতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান শান্তিপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে বলে গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা ট্রাম্পকে সতর্ক করেছিলেন। এখন ট্রাম্পের ওই ঘোষণায় তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থকেরা ও ইসরায়েল সরকার উল্লাস প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
টাইম ম্যাগাজিন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইন পাস হয়। এতে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নেওয়া হবে। কিন্তু এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস অন্তর মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি আদেশে স্বাক্ষর করছিলেন। এর মাধ্যমে এই স্থানান্তর-প্রক্রিয়া ছয় মাসের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস নির্মাণের কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা তেলআবিবেই থাকছে।
এদিকে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের কারণে ওই অঞ্চলে উত্তেজনার আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিজ দেশের নাগরিকদের জেরুজালেমের ওল্ড সিটি ও ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এড়িয়ে চলতে বলেছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিয়ে বহু দিনের মার্কিন নীতি থেকে সরে আসছেন ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ট্রাম্পের ওই ঘোষণার আগেই উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে চীন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল বলেন, তাঁরা এই পদক্ষেপের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং সুয়াং গতকাল নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেবে।
মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়া-বিষয়ক জাতিসংঘের দূত নিকোলে ম্লাদেনোভ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ বিষয়টির সুরাহা করতে হবে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে।
যুক্তরাজ্যের স্কাই নিউজ জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে আমি গভীর উদ্বেগকে লুকিয়ে রাখতে পারছি না। জাতিসংঘের প্রস্তাবের আলোকে শহরটির (জেরুজালেম) বিদ্যমান অবস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।’