১০ সপ্তাহ ধরে নিদারুণ কষ্টে ভুগেছেন জারকা। কাটা নাকের ক্ষত যেন আরও দগদগে হয়ে উঠেছিল মনের তীব্র কষ্টে। বুঝেই উঠতে পারছিলেন না, কোন দোষে জীবনে এই নিয়তি তার। অবশেষে একটু যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন জীবনে। ছোট্ট আয়নাটা এখন মুখের সামনে নিয়ে নিজের দিকে তাকাতে পারছেন জারকা। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জারকার সেই বিভীষিকাময় গল্প।
আফগানিস্তানের খাইরকট জেলার ২৮ বছরের গৃহবধূ জারকার জীবনে দুই মাস আগে যেন এক নরক নেমে এসেছিল। ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে ৬ বছর বয়সী এক ছেলের মা হয়েও প্রায় প্রতিদিনই স্বামীর হাতে বেদম পিটুনি খেয়েছেন তিনি। তবে ওই দিন যেন সব সীমাই ছাড়িয়ে যায়। বাড়ির পাশের বাগানে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে যান তাঁর স্বামী। ছুরি হাতে ভয়ংকর মূর্তি ধরেন। নির্মমভাবে কেটে নেন তাঁর নাক। রক্তের নদীতে যেন ভাসতে থাকেন জারকা। তাঁর আর্তনাদে ছুটে আসেন আশপাশের মানুষ। পালিয়ে যান স্বামী। নির্মম অন্তর্জ্বালা নিয়ে পড়ে থাকেন তিনি।
জারকাকে প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ একজন তাঁর নাকের বিচ্ছিন্ন অংশ নিয়ে আসেন। তবে ওই চিকিৎসক জানান, তার পক্ষে নাক জোড়া লাগানো সম্ভব না। এ পরিস্থিতিতে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছিল জারকার। কী যে কষ্ট। সে কথা মনে করে এখন শিউরে ওঠেন জারকা।
জারকার গ্রাম তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ওপর হামলার পর স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও জঙ্গিদের মধ্যে আলোচনা হয়। এক সময় তাঁকে চিকিৎসার জন্য কাবুল নেওয়া হয়। কাবুলে চিকিৎসক জালমাই খান আহমাদজাইয়ের কাছে নেওয়া হয় তাঁকে। সে সময় ৪৯ বছর বয়সী জালমাইয়ের জীবনেও ঝড় বয়ে গেছে। সপরিবারে করোনায় সংক্রমিত হন তিনি। স্ত্রী মারা যান। স্ত্রীকে শেষ বিদায় দিয়ে আবার কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন তিনি। জারকার অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাঁর নাকের কাটা অংশে সংক্রমণ দেখা দেয়। জালমাই তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ধরনের ওষুধ দেন। পাঁচ সপ্তাহ পরে আবার কাবুলে আসেন জারকা। ২১ জুলাই তাঁর নাকের কাটা অংশ জোড়া লাগাতে অস্ত্রোপচার করেন জালমাই।
নাক হারিয়ে প্রচণ্ড কষ্টে ছিলেন জারকা। চেহারা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি তাঁকে অসম্ভব কষ্ট দিচ্ছিল। জারকা কেবল তাঁর নাক ফিরে পেতে চেয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর পুলিশ গ্রেপ্তার করে জারকার স্বামীকে। এখন তিনি কারাগারে।
বলা যায়, এত কষ্টের মধ্যেও কিছুটা আশার আলো দেখতে পান জারকা। তাঁর রক্তাক্ত মুখের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পারিবারিক সহিংসতার ভয়ংকর চিত্র উঠে আসে, যা আগেই নজরে পড়েছিল চিকিৎসক জালমাইয়ের। তিনি তাঁকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হবে জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন। আরও কয়েকজনের সহায়তায় জারকাকে কাবুলে এনে অস্ত্রোপচার করেন তিনি। জালমাই অস্ত্রোপচার করেন বিনা মূল্যে। একই সঙ্গে ওষুধের সব খরচও বহন করেন কয়েকজন। জালমাই জারকাকে আশ্বাস দিয়েছেন নাক ফিরে পাবেন তিনি। আবার আগের চেহারা ফিরে পাবেন।
পারিবারিক সহিংসতা নতুন নয় আফগানিস্তানে। ইউএন পপুলেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ আফগান নারী জীবনে কোনো না কোনো ধরনের শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। সবচেয়ে খারাপ হলে স্বামী বা পরিবারের পুরুষ সদস্যের দ্বারা হামলার শিকার হন। কখনো ছুরি দিয়ে আহত করা হয়, কখনো-বা অ্যাসিড দিয়ে দগ্ধ করা হয়। জারকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। লেখাপড়া না জানা জারকার বিয়ে ঠিক করা হয় একদম ছোটবেলায়। ১৮ বছর বয়সে স্বামীর ঘরে যান জারকা। তখন থেকে নির্যাতনের শিকার হন উগ্র স্বামীর হাতে।
এমনকি এখনো জারকার সন্তান রয়েছে তাঁর স্বামীর বাড়িতে, তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে। ছেলের জন্য মন পুড়ে জারকার। তবে সাহস করে যেতে পারেন না। জারকার বাবার বাড়ির লোকজন পরামর্শ দিয়েছেন সন্তানকে ভুলে যেতে। না হলে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে নতুন রোষে হামলা চালাতে পারেন তাঁর স্বামী। তবে সন্তানকে ভুলে থাকা তো সম্ভব নয় জারকার পক্ষে। ভাবছেন সন্তানের জন্য নতুন লড়াইয়ে নামার।