জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার দৈনিক হিসাব এখন প্রায় প্রতিদিন পুরোনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ে নিচ্ছে। তবে রেকর্ডের এই ভাঙাগড়ার মধ্যে নেই গৌরবের কোনো ছাপ, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভয় আর আতঙ্ক। ফলে রেকর্ড গড়ার কথা কানে এলে মানুষ এখন আর উদ্দীপনা বোধ করে না, বরং শঙ্কিত মন নিয়ে ভাবে নিজে কখন নতুন রেকর্ডের খপ্পরে পড়ে যায়। ফলে মানুষের মনের দুর্ভাবনা বেড়ে চলেছে।
তবে আতঙ্কের মধ্যেও টোকিওর জনবহুল জায়গাগুলো এখন আবারও লোকজনের ভিড়ে পরিপূর্ণ হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে সরকারও মনে হয় হাত গুটিয়ে নেওয়ার অবস্থায়। সাধারণ মানুষ ও সরকার, উভয়ের বেলায় এর কারণ হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে করোনাভাইরাসের দাপটে বিরাজমান থাকা। মানুষ ঘরে বসে হাঁপিয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাহির এখন আবারও তাঁকে ডাকছে জীবনের উপভোগ্য দিকগুলোর সান্নিধ্যে আরও একবার আসার জন্য। আর তাই রাতের বিনোদনের জায়গা, যেগুলোকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্লাস্টার বা গুচ্ছ হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব প্রমোদপুরি এখন আবার সচল আর কোলাহলময়। ফলে নতুন রেকর্ড গড়া থেমে নেই।
অন্যদিকে সরকারও আশু করণীয় নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছে। জাপানের অর্থনীতি করোনার আঘাতে পঙ্গু হয়ে না পড়লেও নিজের গতি তা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সব রকম হিসাবের দিক থেকে অর্থনীতি এখন দ্রুত না হলেও যথেষ্ট তেজি ভাব নিয়ে নিম্নমুখী। এই অবস্থা আরও বেশি দিন চলতে থাকলে অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ফলে সংক্রমণ সামাল দেওয়ায় আবারও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা কিংবা লকডাউনের মতো আরও কিছুটা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সরকার এখন আর বিবেচনা করে দেখছে না। এ–ও যেন সাধারণ মানুষের মতোই ভূতের তাড়া খাওয়া নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়া অবস্থা। ফলে এই পরিস্থিতিও রেকর্ড গড়ায় ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে।
মাত্র গতকাল জাপানে এক দিনে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে নেয়। আর আজ বৃহস্পতিবার টোকিও গড়ে নিয়েছে দৈনিক হিসাবের নতুন আরেক রেকর্ড। জাপানের রাজধানীতে আজ বৃহস্পতিবার ৩৬৭টি নতুন সংক্রমণ চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে এ পর্যন্ত দৈনিক হিসাবে সর্বোচ্চ এবং চলতি মাসের ২৩ তারিখে হওয়া আগের রেকর্ডের চেয়ে একটু বেশি। টোকিওর গভর্নর ইয়ুরিকো কোইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে করোনাভাইরাসকে দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রাজধানীবাসীদের নিয়মিতভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া অব্যাহত রাখলেও মানুষ এখন আর আগের মতো সেই ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তারপরও গভর্নর তাঁর প্রচেষ্টা বজায় রেখে চলেছেন।
করোনাভাইরাসের ভীতি থেকে যাওয়া সত্ত্বেও জাপানে মানুষের আবারও বহির্মুখী জীবনে ফিরে যাওয়ার আকুতির পেছনের আরেকটি কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। সারা জাপানে আজ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমণে শনাক্ত হওয়া মানুষের মোট সংখ্যা হচ্ছে ৩৪ হাজার ১০০ জনের একটু বেশি। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ১৯ জন। তুলনামূলক হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা তেমন বেশি নয়। মে মাসের পর থেকে ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং এখন তা যথেষ্ট মাত্রায় কমে এসেছে। এর কারণ হলো, অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া, শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যাদের মধ্যে বৃদ্ধদের চেয়ে অনেক বেশি। টোকিওতে যেমন চলতি মাসের করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া লোকজনের মধ্যে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ হচ্ছেন ২০ আর ৩০–এর ঘরের তরুণেরা। তবে বিপজ্জনক দিকটি হলো, বাড়িতে ফিরে গিয়ে তাঁরা বৃদ্ধদের সংস্পর্শে এলে পরিস্থিতি হয়তো ভয়াবহ আকার নিতে পারে। ফলে সাবধানে থাকার উপদেশ তাঁদের দেওয়া হচ্ছে এবং সেই পরামর্শ এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে বলে মনে হয়।
তবে এই করোনাকালে জাপানের সবটাই যে অন্ধকারাচ্ছন্ন, তা কিন্তু নয়। জাপানের জাতীয় পুলিশ এজেন্সি বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাস সময়ে দেশে অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা ১৫ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়। এই সময়ে দেশজুড়ে অপরাধের ঘটনা ঘটেছে ৩ লাখ ৭ হাজারের মতো, যা হচ্ছে ষাণ্মাসিক হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ের সর্বনিম্ন। পুলিশের মতে, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বাড়িতে অবস্থান করায় চুরি-ডাকাতির পাশাপাশি সাইকেল চুরি হওয়ার মতো পথের অপরাধ অনেকটাই কমে গেছে।
তবে সনাতন অপরাধ কমে গেলেও অন্যদিকে আবার বেড়ে চলেছে সাইবার অপরাধের মতো নতুন সংজ্ঞাভুক্ত অপরাধ। তবে সাইবার অপরাধ একক কোনো দেশের মধ্যে সীমিত না থাকায় এসব অপরাধের তালিকাভুক্তি কিছুটা সমস্যাসংকুল। জাপানে কিংবা অন্যান্য দেশে এরা সক্রিয় থেকে গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরা তা করছে অন্য কোনো একটি দেশে বসে। ফলে সাইবার অপরাধ দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর ক্রমেই আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে জাপান ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেশ।