জাপানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শরণার্থীদের নিয়ে একধরনের ভীতি কাজ করে। তাই বাইরের আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণে জাপানের অনীহা নতুন কিছু নয়। জাপান যে শুধু কপাট বন্ধ করে বসে থাকে, তা-ই নয়। দেশের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে আটক আশ্রয় গ্রহণকারীদের প্রতি বৈরী আচরণের বিষয়টিও সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এখন আর অজানা নয়।
মাত্র এক বছর আগে আটকাবস্থায় থাকা শ্রীলঙ্কার তরুণী উইশমা সান্দামালির করুণ মৃত্যু জাপানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল। সে ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতিতে জাপান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে সে ব্যাপারে যে খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে তা অবশ্য নয়। এমনকি উইশমার পরিবার সম্প্রতি জাপানের আদালতে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা দায়েরের পর সরকার এখন বলছে, বিষয়টি নিয়ে আদালতে সরকার লড়াই করবে। অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে আটক থাকা অবস্থায় আরও বেশ কয়েকটি মৃত্যুর খবরও বিগত বছরগুলোতে প্রচারিত হয়।
অন্যদিকে আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণ করার বেলাতেও জাপানের কড়াকড়ি চোখে পড়ার মতো। দেশের বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাপান মাত্র ৭৪ জন আবেদনকারীকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়েছিল। অন্যদিকে আবেদনের মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪১৩। পরিসংখ্যান দেখিয়ে দিচ্ছে, শরণার্থীর স্বীকৃতি লাভ করা জাপানে নেহাত ভাগ্যের ব্যাপার।
সেই জাপানকেই এখন হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে দূরদেশের কিছু শরণার্থীর জন্য কান্নায় বুক ভাসাতে। বিষয়টি একদিকে এ রকম আশা জাগিয়ে তুলছে যে আশ্রয়প্রত্যাশীদের বেলায় জাপানের নীতিগত কঠোর অবস্থানের বরফ হয়তো গলতে শুরু করছে। অন্যদিকে এমন ধারণাও সৃষ্টি হয়েছে যে জাপানের জনগণও এখন হয়তো আরও একটু বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে এদের দুর্দশা অনুধাবন করতে পারছে। তবে শরণার্থীদের বিষয়ে এ আবেগের পেছনে বর্ণবাদী আচরণ এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়ার পাঁয়তারাই চোখে পড়ে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে জাপান পশ্চিমের শিবিরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মস্কোকে শায়েস্তা করার জন্য যতটা পারা যায় একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে। রাশিয়ার যেসব ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা জাপান দিয়েছে, সেই তালিকায় রুশ প্রেসিডেন্টের দুই মেয়েও আছেন। যদিও বলা হয়নি তাঁদের কোন ধরনের কিংবা কী পরিমাণ সম্পদ জাপানে আছে। অন্যদিকে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ নিতে শুরু করলে দেশের অর্থনীতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের দিকটি ভাবনায় এনে জাপানকে অনেকটা বাধ্য হয়েই আংশিকভাবে সরে আসতে হয়। ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য জাপানের কান্নাকাটির শুরুটাও বলা যায় সেই সময় থেকে।
জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি মার্চ মাসে পোল্যান্ড সফরে গেলে ফেরার পথে সরকারি বিমানে ইউক্রেনের বেশ কয়েকজন শরণার্থীকে জাপানে নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে সরকার ঘোষণা করে, ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউক্রেনের নাগরিকদের জন্য জাপানের দুয়ার খোলা থাকবে। শুধু তাই নয়, শরণার্থীদের যেন কোনো রকম অসুবিধায় পড়তে না হয়, সে জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পাশাপাশি দৈনিক ভাতাও দেওয়া হবে।
ওই ঘোষণার পর থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের ১ হাজার ৫৫ নাগরিক জাপানে চলে আসেন। আগামী দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে অনেকেই মনে করছেন। কেননা এ রকম ঘোষণাও সরকার দিয়েছে, পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুতরা জাপানে আসতে চাইলে পোল্যান্ড থেকে জাপানে আসার বিমানের টিকিটও তাঁদের দেওয়া হবে। জাপানে চলে আসার পর থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য শরণার্থীদের মাথাপিছু এককালীন থোক সাহায্য বাবদ ১ লাখ ৬০ হাজার ইয়েন বা ১ হাজার ২৪০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি জাপান সরকার দিয়েছে। এর বাইরে ২৪ বছর বা বেশি বয়সীদের দৈনিক ভাতা বাবদ প্রায় ১৯ ডলার দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা বিনা মূল্যের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন এবং তাঁদের জন্য নিখরচায় জাপানি ভাষা শেখার বিশেষ কোর্সও চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের শরণার্থীরা যেন সহজেই চাকরি খুঁজে পেতে পারেন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ে সে জন্য বিশেষ পরামর্শ সেবা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেনের শরণার্থী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তির কর্মসূচি চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এ যেন রীতিমতো জামাই আদর।
কেবল কেন্দ্রীয় সরকার নয়, জাপানের বিভিন্ন স্থানীয় সরকারও ইউক্রেন থেকে আসা আশ্রয় গ্রহণকারীদের উদার সহায়তা দিচ্ছে। ওসাকা জেলা সরকার যেমন প্রতিটি পরিবারের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বাইরে এককালীন পাঁচ লাখ ইয়েন আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা বলছে। এর বাইরে জাপানের বাণিজ্যিক খাতও নানাভাবে ইউক্রেনের শরণার্থীদের সাহায্য করে চলেছে।
জাপানের কৃষি, বন ও মৎস্য মন্ত্রণালয় অবশ্য অন্য সবার চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে। তারা ঘোষণা করেছে, ইউক্রেনের আশ্রয়প্রার্থীরা জাপানে আসার সময় নিজেদের পোষা কুকুর-বিড়াল নিয়ে এলে পোষা জীবজন্তুর জন্য বাধ্যতামূলক ১৮০ দিনের কোয়ারেন্টিনে সেসব জীবজন্তুকে থাকতে হবে না। কুকুর-বিড়ালের সঙ্গ হারিয়ে ইউক্রেনীয়দের যেন নিঃসঙ্গ বোধ করতে না হয়, সে জন্য বিমানবন্দরে তাৎক্ষণিক পরীক্ষা শেষ করে মালিকের সঙ্গে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা সেসব প্রাণীর জন্য করে দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধ্ব পর্যন্ত শরণার্থীদের সঙ্গে আসা পাঁচটি কুকুর সেই বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় জাপানে ঢুকেছে।
শরণার্থীদের প্রতি কঠোর একটি দেশের হঠাৎ করে এতটা উদার হয়ে যাওয়াটা কিন্তু সবার বেলায় দেখা যাচ্ছে না। এ সুযোগ যে কেবল ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য সীমিত, সেই সত্য সরকার চেপে রাখছে না। জাপানের ভেতরও অনেকেই এটাকে পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি রাখার জন্য জাপানের গ্রহণ করা বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে দেখছেন।
অন্যরা আবার জাপানের সুপ্ত বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবেও এটাকে মনে করছেন। জাপানের সংবাদমাধ্যমও ইদানীং বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক আসাহি শিম্বুন–এ কিছুদিন আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের অবস্থার সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের তুলনা করে বৈষম্যের ছবি আরও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়। সেই প্রতিবেদনের জন্য দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাপানে অবস্থানরত একজন আফগান আশ্রয়প্রত্যাশী বলেছেন, তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের লোকজনকে সাহায্য করা ভালো এক উদ্যোগ। তবে অন্য দেশের শরণার্থীদের প্রতি দেখানো আচরণের সঙ্গে তুলনা করা হলে এটাকে নগ্ন বৈষম্য ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। জাপানের কিছু লোকও এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচনা করছেন।
অন্যদিকে ইউক্রেনের শরণার্থীরা জাপানের এতটা উদার আচরণের সুযোগ গ্রহণ করে নানা রকম অসৎ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ থেকেও পিছিয়ে নেই। ইউক্রেন থেকে শরণার্থী হয়ে আসা কিছু তরুণীর টোকিওর নাইটক্লাব ও পানশালাগুলোতে হোস্টেসের কাজে নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর জাপানের বিচারমন্ত্রী ইয়োশিহিসা ফুরুকাওয়া সতর্ক করে বলেছেন, আশ্রয়প্রত্যাশীদের মনে রাখা দরকার, ভিসার শর্তাবলি সে রকম কাজে জড়িত হওয়ার অনুমতি দেয় না।