লাদাখে চীনের সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ভারতীয় সেনার সংখ্যা ২০ বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এর আগে সংঘর্ষে তিনজন সেনাসদস্যের নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, গত সোমবার দিবাগত রাতে ওই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন কর্নেল পদমর্যাদার রয়েছেন।
উত্তেজনা প্রশমনের চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যেই ফের উত্তপ্ত হলো লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা। ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় গলওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে সোমবার রাতে ঘটে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, প্রাণহানি ঘটেছে চীনাদেরও। এনডিটিভির খবরে বলা হচ্ছে, ৪৩ জনেরও বেশি চীনা সেনাসদস্য গুরুতর আহত হয়েছে বা মারা গেছে। তবে চীনের পক্ষ থেকে নিজেদের হতাহত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় দুই পক্ষই নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। এর মধ্যেই সোমবার রাতে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই পক্ষই সভা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
এদিকে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবরে বলা হয়, এই সংঘর্ষের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, সোমবার ভারতীয় সেনারা দুবার সীমান্তরেখা অতিক্রম করেছে। তার দাবি, ‘উসকানিমূলকভাবে চীনের সেনাদের আক্রমণ করে, পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।’
ভারত ও চীনের সীমান্তবিরোধ সময়ে সময়ে তীব্র হলেও দীর্ঘ সাড়ে চার দশকে কোনো পক্ষে প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। শেষবার মৃত্যু হয়েছিল চার ভারতীয় টহলদারি সেনার। ১৯৭৫ সালে। অরুণাচল প্রদেশের টুলুং লায়। তারপর এবার লাদাখে। সোমবারের এই ঘটনা সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক।
সংঘর্ষে প্রাণহানি হলেও কোনো পক্ষ থেকে গুলি চালানো হয়নি। সেনাদের মৃত্যু হয়েছে হাতাহাতি, রডের ব্যবহার ও পাথর ছোড়াছুড়িতে। কীভাবে ও কেন এই সংঘর্ষ, তার বিস্তারিত বিবরণ কোনো পক্ষেই নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী গতকাল মঙ্গলবার যে বিবৃতি দেয়, তাতে বলা হয়েছে, গলওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা কমানোর চেষ্টার মধ্যে সোমবার রাতে হঠাৎ সংঘর্ষ বাধে। তাতেই সেনাসদস্যদের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, চীনের গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, সংঘর্ষে চীনা সৈন্যরাও হতাহত হয়েছে। ভারতের বোঝা উচিত, চীনের সংবরণ দুর্বলতা নয়। ভারত ঔদ্ধত্য কমাক। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার কমান্ডের মুখপাত্র ঝ্যাং শুলির দাবি, ভারতীয় সেনাদের উসকানিতেই সোমবারের সংঘর্ষ বেধেছে। ওই উসকানির কারণেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং তা থেকে হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
সোমবার রাতের এই খবর গতকাল দুপুর নাগাদ জানাজানি হয়। গতকাল সকালেই তা জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। দুপুরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জরুরি বৈঠক করেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত ও স্থল, বায়ু ও নৌপ্রধানদের সঙ্গে। সেই বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচিত হয়।
ভারত–চীন সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। দীর্ঘ এই সীমান্তে কাশ্মীরের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু এলাকা সময় সময় উত্তপ্ত হয়। লাদাখের গলওয়ান এমনই এক বিতর্কিত অঞ্চল। মে মাসের শুরুতে এই এলাকার গলওয়ান উপত্যকা, প্যাংগং লেক ও সিকিমের নাকু লায় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। ভারতের অভিযোগ, গলওয়ানে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার ভারতীয় জমিতে এসে চীনা ফৌজ একাধিক ছাউনি গড়ে তোলে। খবর পেয়ে তাদেরই মুখোমুখি হয় ভারতীয় সেনা। এই নিয়ে দুই পক্ষে প্রায়ই হাতাহাতি হতে থাকে। হাতাহাতি হয় প্যংগং লেকে টহলদারি নিয়েও। স্থানীয় সামরিক কর্তাদের দৌত্য বিফলে গেলে জুন মাসের গোড়ায় উত্তেজনা প্রশমনে দুই পক্ষ মেজর জেনারেল পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে। এতে কিছুটা কাজ হলেও গলওয়ান অঞ্চলের উত্তেজনা যে কমেনি তা সোমবারের ঘটনায় প্রমানিত।
কয়েক বছর ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত বিভিন্ন ধরনের সামরিক অবকাঠামো তৈরিতে মন দিয়েছে। লাদাখের রাজধানী লেহ্ থেকে দৌলত বেগ ওলডি বায়ুসেনাঘাঁটি পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা চীনের চক্ষুশূল। দৌলত বেগ ওলডি বায়ুসেনাঘাঁটি গত অক্টোবরে উদ্বোধন হয়। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এই রাস্তা ও বায়ুসেনাঘাঁটি সামরিক দিক থেকে ভারতকে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া চীন সীমান্ত বরাবর ভারত মোট ৬৬টি রাস্তার দিকে নজর দিয়েছে। এগুলোর কিছু নতুন, কিছু রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে চীন তাই বারবার বাধা দেয়। লাদাখের গলওয়ান উপত্যকা অশান্ত রাখাটা তাদের সামরিক কৌশল।
চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ নতুন নয়। সম্প্রতি নেপালের সঙ্গেও ভারত সীমান্ত বিবাদে জড়িয়েছে। উত্তরাখন্ডে ভারত, চীন ও নেপাল সীমান্তবর্তী কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরার ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নেপাল তার নতুন ম্যাপের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই নিয়ে ভারত অস্বস্তিতে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের একাংশের ধারণা, নেপালকে আগ্রাসী করে তুলতে চীন মদদ দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: