নজিরবিহীন আর্থিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কা। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে বিপর্যস্ত দেশটি। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে ধুঁকছিল দেশটির অর্থনীতি। চীনের অর্থায়নের প্রকল্পগুলো সেই অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বেগবান করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি নিজেদের বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করে।
কিন্তু খারাপ বিবেচিত হওয়া অবকাঠামো প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থের অবচয় করা হয়েছে যা সরকারি অর্থের আরও নয়ছয় হয়েছে।
চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো খাতে একের পর এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ও করছে শ্রীলঙ্কা। এসব প্রকল্প থেকে আয় এসেছে সামান্যই। কিন্তু চীনের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। তুমুল জনরোষের মুখে সোমবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, চীনা ঋণের প্রকল্প ও তা বাস্তবায়নের অব্যবস্থাপনায় কি ডুবলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে?
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হামবানটোটা জেলায় প্রভাবশালী রাজাপক্ষ পরিবারের নিবাস। সেখানেই চীনা ঋণে বানানো হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর। ওই বন্দরের আয় দিয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বন্দর নির্মাণের ১৪০ কোটি ডলারের চীনা ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ৬ বছরে ৩০ কোটি ডলার হারিয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে ২০১৭ সালে বন্দরটি একটি চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয় শ্রীলঙ্কা। এর ফলে চীনা অর্থে নির্মিত বন্দর শেষ পর্যন্ত চীনের হাতে চলে যায়।
এ বিষয়ে সেখানকার বাসিন্দা দিনুকা বলেন, ‘শুরুতে এই প্রকল্প নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমাদের কপাল খুলতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন আমাদের কাছে এটার আর কোনো মূল্য নেই। এই বন্দর আমাদের নয়।’
চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার ঋণ নিয়ে একটি সম্মেলেনকেন্দ্র বানিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। সেটিও অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। হামবানটোটা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ২০ কোটি ডলারের চীনা ঋণে বানানো হয়েছে রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে বিমানবন্দরটি এখন বিদ্যুৎবিল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
রাজধানী কলম্বোর পাশে ৬৬৫ একর জায়গায় দুবাইয়ের আদলে বিলাসবহুল কৃত্রিম শহর গড়ছে শ্রীলঙ্কা। এ প্রকল্পেও অর্থায়ন করেছে চীন। তবে সমালোচকদের আশঙ্কা, এই প্রকল্পও চীনা ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণের ১০ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেনা ধরলে তা আরও বেশি হবে। কলম্বোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কাস অ্যাডভোকেট ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মুর্তজা জেফারজি বলেন, কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল শাসন বর্তমান সংকটকে আরও জোরালো করেছে।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। করোনা মহামারির সময়ে এই আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। বিদেশে অবস্থানরত শ্রীলঙ্কানরাও দেশে কম অর্থ পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সংকটের জেরে আমদানি কমে এসেছে। দেশটিতে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। দেখা দিয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ–সংকট।
গত মাসে শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদের ঋণখেলাপি ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে দেশটি। তবে চীন দেশটিকে আরও ঋণ দিতে চায়। নতুন ঋণের অর্থে পুরোনো ঋণ পরিশোধ করবে কলম্বো, এমনটাই চাওয়া বেইজিংয়ের। গত মাসে কলম্বোয় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত কিউই ঝেনহং সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কাকে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচাতে যা করা প্রয়োজন, তার সবই করেছে চীন। এর পরও শ্রীলঙ্কা সরকার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কাজুড়ে চীনা অর্থে নির্মিত ও অব্যবহৃত পড়ে থাকা বড় বড় অবকাঠামোকে রাজাপক্ষের আমলের অব্যবস্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকেই। দেশটির দোকানদার কৃষ্ণানথা কুলাতুঙ্গা বলেন, ‘আমরা গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে আছি। খাবার না জুটলে এই টাওয়ারের আলো ঝলকানি দিয়ে আমরা কী করব?’