হংকংয়ে পালিয়ে বেড়ানো সৌদি আরবের দুই বোনের দিন কাটছে এখন প্রত্যাবাসন আতঙ্কে। সৌদি আরবে নিজ পরিবার কর্তৃক ক্রমাগত শারীরিক নির্যাতন ও পুরুষ সদস্যদের কাছে বন্দী জীবন থেকে বাঁচতে প্রায় ছয় মাস আগে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে পালিয়েছিলেন। মাঝ যাত্রাপথে হংকংয়ে তাঁদের বাধা দেন সৌদি কূটনৈতিক কর্মকর্তারা। তাঁদের অস্ট্রেলিয়াগামী ফ্লাইট বাতিল করা হয়। গত নভেম্বরে তাঁদের পাসপোর্ট বাতিল করে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে তাঁরা রাষ্ট্রহীন জীবন কাটাচ্ছেন হংকংয়ে।
হংকংয়ের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে ওই দুই বোনকে। এরপর তাঁদের হংকং থেকে বের করে দেওয়া হবে।
ওই দুই বোন নিজেদের রিম (২০) ও রাওয়ান (১৮) নামে বার্তা সংস্থা এএফপিকে পরিচয় দিয়েছেন। তবে এগুলো তাঁদের ছদ্মনাম। তাঁরা এএফপিকে তাঁদের জীবনের গল্প বলেছেন।
সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন রিম। লেখক হতে চাওয়া এই তরুণী বলেন, সাহিত্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। ব্রিটিশ-ভারতে জন্মগ্রহণকারী ইংরেজ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোর তাঁর প্রিয় বই। রিম বলেন, ‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু এটা সৌদি আরবে বাস্তবে ঘটছে। আপনার সমস্ত জীবন সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।’
কেন পালালেন?
রিয়াদের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠেন রিম ও রাওয়ান। অতিরক্ষণশীল সৌদি আরবে নারী হিসেবে জীবনের কোনো স্বাধীনতা ছিল না বলে জানান দুই বোন। সৌদি আরবে থাকাকালে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তাঁদের প্রতিনিয়ত নির্যাতন করতেন। তাঁরা বলেন, যখন ছোট ছিলেন, তাঁদের বাবা তাঁদের মারধর করতেন। যখন বড় হলেন, মারধর করা শুরু করলেন তাঁদের ভাইয়েরা। ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার মতো ছোট ছোট অপরাধের জন্য তাঁরা মারধর করতেন। বাবা ও ভাইদের কিছু বলতেন না বলে জানান তাঁরা।
এমনকি তাঁদের ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইও তাঁদের মারধরে অংশ নিত বলে জানান এই দুই তরুণী। রিম বলেন, ‘সে শুধুই একজন শিশু ছিল। কিন্তু এসব সে শিখেছে বড় ভাই ও বাবাকে দেখে। এমনকি তার চারপাশের সব পুরুষকে দেখে। সে শিখেছে, এটাই পুরুষ হওয়ার সঠিক পথ এবং নারীদের সঙ্গে এভাবেই আচরণ করতে হয়।’
কীভাবে পালালেন?
দুই বোন সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা বাড়ি ছেড়ে বিদেশে পালাবেন। দুই বছর ধরে তাঁরা পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। এ সময় অস্ট্রেলিয়ার ভিসা করে রাখেন তাঁরা। এরপর পালানোর সুযোগ এল। গত সেপ্টেম্বরে রাওয়ানের ১৮তম জন্মদিনে পরিবার শ্রীলঙ্কায় ছুটি কাটাতে এল। এ সময় তাঁদের পাসপোর্ট বাবা-মায়ের ব্যাগে ছিল। বাবা-মা যখন ঘুমাচ্ছিলেন, দুই বোন তাঁদের পাসপোর্ট নিয়ে কলম্বো থেকে হংকংয়ের ফ্লাইটে চেপে বসেন।
হংকংয়ে অপেক্ষা করছিল বিপদ
হংকং বিমানবন্দরে কিছু অচেনা লোক তাঁদের যাত্রাবিরতিতে আটক করেন। তাঁদের অস্ট্রেলিয়াগামী ফ্লাইট বাতিল করান। একজন রিয়াদগামী উড়োজাহাজে তাঁদের কৌশল করে বসাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। পরে জানতে পারেন, ওই লোক হংকংয়ে সৌদি আরবের কনসাল জেনারেল ছিলেন।
গতিবিধি ট্র্যাক করা হয়েছে
দুই বোন সন্দেহ করছে, তাঁদের বাবা আবশের অ্যাপ দিয়ে তাঁদের গতিবিধি ট্র্যাক করেছেন। আবশের একটি বিতর্কিত মুঠোফোন অ্যাপ। সৌদি আরবে এর মাধ্যমে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নারী সদস্যদের ওপর নজরদারি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতা রন ওয়াইডেন এর সমালোচনা করে গুগল ও অ্যাপলকে তাদের স্মার্টফোন থেকে এই অ্যাপ সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানান।
দুই বোন বলেন, তাঁদের পাসপোর্টের তথ্য অ্যাপে দেওয়া ছিল। তাঁরা যে ফ্লাইট বুক করেছেন, সেটি ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের বাবা। তাঁরা বলেন, তাঁদের চাচার সরকারি যোগাযোগ রয়েছে। হয়তো তিনি কনস্যুলার কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছেন।
দুই বোন হংকংয়ে গত ছয় মাসে নিরাপত্তা শঙ্কায় ১৩ বার অবস্থান বদল করেছেন। হোটেল, হোস্টেল, ভাড়া বাসা, এমনকি নৌকাতেও এক রাত কাটিয়েছেন তাঁরা। ইনস্ট্যান্ট নুডলস ও টোস্ট খেয়ে এক মাস কাটিয়েছেন। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের অপহরণ করা হতে পারে। সৌদি আরবে নিয়ে গিয়ে তাঁদের খুন করা হতে পারে, অথবা তাঁদের জোর করে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতে পারে।
প্রায় দেড় মাস আগে ১৮ বছর বয়সী সৌদি তরুণী রাহাফ মোহাম্মদ আল-কুন সৌদি আরব ছেড়ে পালিয়ে বিশ্বে হইচই ফেলে দেন। তিনি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন।