শ্রীলঙ্কায় ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। যে রাজনীতিবিদদের এত দিন নায়কের চোখে দেখা হতো, নজিরবিহীন সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কার জনগণের চোখে তাঁদের অনেকেই এখন খলনায়ক। জনরোষ থেকে বাঁচতে তাঁদের অনেকেই এখন লুকিয়ে রয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। সেখান থেকে কেউ বাইরে আসছেন না। বিশেষ করে সরকারি দলের রাজনীতিবিদেরা এখন তোপের মুখে। খবর বিবিসির
করোনার ধাক্কার পাশাপাশি সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছে দেশটি।
জনরোষের মুখে পড়া শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদেরা এখন বিপদে রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই জনসম্মুখে আসছেন না। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, চলছে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। এ পরিস্থিতিতে সরকার পতনের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা। গত সোমবার তুমুল বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তাতেও জনরোষ কমেনি।
শ্রীলঙ্কায় কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠার পর বিক্ষোভকারীদের দমাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করে সরকার। বিক্ষোভস্থলে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও বেড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটিতে যারা জনগণের সম্পদ নষ্ট করবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কারও ক্ষতি করবে, তাদের গুলি করার জন্য বুধবার তিন বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে গুলির নির্দেশ দেওয়ার খবর অস্বীকার করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষাপ্রধান ও সেনা কমান্ডার জেনারেল শাভেন্দ্র সিলভা।
পরিস্থিতি মোটেও নিরাপদ নয়, বিশেষ করে সরকারের পক্ষের রাজনীতিবিদদের জন্য।নালাকা গোদাহেওয়া, শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমবিষয়ক মন্ত্রী
বিবিসি জানায়, জনরোষের মুখে পড়া শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদেরা এখন বিপদে রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই জনসম্মুখে আসছেন না। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বাসভবনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়ার মেয়র সালমান লাল ফার্নান্দো এবং এমপি সনাৎ নিশান্ত, রমেশ পাথিরানা, মাহিপালা হেরাথ, থিসা কুত্তিয়ারাচ্চি ও নিমল লাঞ্জার সরকারি বাসভবনও পুড়িয়ে দিয়েছেন।
ডেইলি মিরর–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার পুদুজানা পেরামুনা দলের এমপিদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার পুদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দলের কিছু কার্যালয়ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমবিষয়ক মন্ত্রী নালাকা গোদাহেওয়া বিবিসিকে বলেন, ‘পরিস্থিতি মোটেও নিরাপদ নয়, বিশেষ করে সরকারের পক্ষের রাজনীতিবিদদের জন্য।’ তাঁর বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
বিবিসি বলছে, মাহিন্দা রাজাপক্ষে তামিল বিদ্রোহীদের পরাজিত করে একসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলির কাছে নায়ক বনে গিয়েছিলেন। সেই তিনিই হঠাৎ খলনায়ক হয়ে উঠেছেন। অনেকে তাঁর সমর্থকদের সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে হামলা চালানোর অভিযোগ করেছেন। এই হামলার পর থেকেই দেশটিতে সহিংস ঘটনাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজাপক্ষে পরিবার সবক্ষেত্রে সব সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে। তবে এবারই প্রথম তাদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছে দেশটি। ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, চলছে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট।
এই পরিস্থিতিতে সরকার পতনের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে। অচলাবস্থা নিরসনে গত শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে বলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া সম্পর্কে মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছোট ভাই। এক যুগ আগে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতাকামী তামিল টাইগারদের দমন করে দেশে রাজাপক্ষে পরিবারের আধিপত্য তৈরি করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। সে সময় সাবেক সেনা কর্মকর্তা গোতাবায়াকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এনেছিলেন তিনি। সেই প্রেসিডেন্ট যখন মাহিন্দাকে পদত্যাগ করতে বলেন, তখন ঐক্যে ফাটল ধরা স্বাভাবিক। বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী পরিবার কীভাবে এই সংকট কাটিয়ে উঠবে, তা এখন একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন।
তবে রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহিন্দার ছেলে নামাল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, তাঁর পরিবার এখন শুধু একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজাপক্ষে পরিবারের শ্রীলঙ্কা ত্যাগের কোনো পরিকল্পনা নেই।
রাজাপক্ষে পরিবারের আর কাউকেই সরকারে দেখতে চান না বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মাহিন্দার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ চান।
মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর যাতে সংসদ সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য বিক্ষোভকারীরা দেশটির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছেন।
মাহিন্দার ছেলে নামাল একজন সংসদ সদস্য। তাঁকে রাজাপক্ষে পরিবারের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তবে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
নামাল বলেন, ‘অনেক গুজব আছে যে আমরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। আমরা দেশ ছাড়ব না।’ রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে জাতীয় ক্ষোভকে একটি বাজে সময় হিসেবে বর্ণনা করেন নামাল।
নামাল জানান, তাঁর বাবা মাহিন্দা আইনপ্রণেতা হিসেবে পদত্যাগ করবেন না। তিনি তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে চান। তাঁর বাবা বর্তমানে নিরাপদে আছেন। তিনি নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাসচিব কমল গুনারত্নে। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী যেখানে যেতে চান, সেখানে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর জানায়, দেশজুড়ে চলমান টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল রাজধানী কলম্বোয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কমল গুনারত্নে। এ সময় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রিজের সামনে বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে উঠলে নিরাপত্তার জন্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
কমল গুনারত্নে আরও জানান, এখন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ত্রিঙ্কোমালির নৌঘাঁটিতে রয়েছেন। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে তাঁকে তাঁর পছন্দমতো জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হবে।
চলমান বিক্ষোভের লাগাম টানতে শুক্রবার শ্রীলঙ্কাজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। চলছে কারফিউ। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পর তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তবে দেশটিতে সেনা মোতায়েন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে রাজধানী কলম্বোয় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।