ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির উপস্থাপক ইয়ালদা হাকিমের জন্ম আফগানিস্তানে। গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় তাঁর পরিবার দেশ ছাড়ে। তবে হাকিম আফগানিস্তান নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন করে আসছিলেন। গত আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের হাতে যাওয়ার পর হাকিম প্রথমবারের মতো তাঁর মাতৃভূমিতে ফিরেছেন।
তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে ফেরার পর হাকিমের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেমন পশ্চিমা সমর্থিত সরকার উৎখাত হওয়ার পর তালেবানের অধীন আফগানদের জীবনে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে? আফগানরা কি কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে পেয়েছে? নতুন শাসনে দেশটির নারী ও মেয়েদের ভবিষ্যৎ কী? হাকিম এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
হাকিম দেশটির রাজধানী কাবুল থেকে কান্দাহারে ঘুরেছেন। তাঁর এ অভিজ্ঞতা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিবিসি অনলাইনে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে তালেবানের শাসনামলে আফগানিস্তানের দরিদ্র মানুষের জীবনের দুর্বিষহ চিত্র উঠে এসেছে।
হাকিমের বিবরণ অনুযায়ী, পশ্চিমা সমর্থিত সরকার পতনের পর দেশটির সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা বেতন পাননি। তবুও তাঁরা কাজে যাচ্ছেন। অথচ তাঁদের অবস্থাই নাজুক।
কাবুলের ইন্দিরা গান্ধী শিশু হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাসরিন। তিনি হাকিমকে জানান, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে তিনি বেতন পাননি। তারপরও তিনি প্রতিদিন কাজে যাচ্ছেন। বেতন ছাড়া তাঁর খুব কষ্টে দিন কাটছে। তাঁর সহকর্মীদের অনেকের অবস্থা একই।
নাসরিন বলেন, ‘আমরা যদি কাজে না আসি, তবে এ হাসপাতালে থাকা শিশুরা মারা যাবে। আমরা কীভাবে তাদের ছেড়ে যাই?’
নাসরিন জানান, বেতন না পাওয়ায় তাঁর পকেটে অর্থ নেই। তাই তিনি প্রতিদিন হেঁটে হাসপাতালে যান। প্রায় ১২ ঘণ্টা কাজ করার পর একইভাবে তাঁকে বাড়িতে ফিরতে হয়। তারপরও তাঁরা মানবিকতার খাতিরে কাজ করে যাচ্ছেন।
আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের হাতে যাওয়ার পর দেশটির অর্থব্যবস্থা মারাত্মক সংকটে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে গচ্ছিত আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ দাতারা অর্থ ছাড় বন্ধ করে দিয়েছে। দেশটির ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অর্থসংকটে সরকারি কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতে পারছে না তালেবান সরকার। যদিও চলতি মাসে তালেবান দাবি করেছে, তারা সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া শুরু করেছে। তবে নাসরিনের মতো অনেকেই এখনো বেতন পাননি।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, আফগানিস্তানের প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অনাহারে ভুগছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশের যথেষ্ট খাদ্য নেই।
নাসরিন কাবুলের শিশু হাসপাতালটির যে ওয়ার্ডে কাজ করেন, সেখানে ভর্তি রয়েছে তিন বছরের শিশু গুলনারা। সে এতটাই দুর্বল যে চোখ খুলে রাখাটাও তার জন্য কঠিন। তার চোখ বসে গেছে। চুল পাতলা হয়ে গেছে। সে যখন জেগে ওঠে, তখন ব্যথায় কাঁদে।
শুধু গুলনারা নয়, আফগানিস্তানের অনেক শিশুরই অবস্থা এখন এমন। ক্ষুধা ও অপুষ্টি এখন এসব শিশুর নিত্যসঙ্গী। শীত মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। শীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই জাতিসংঘ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছে, আফগানিস্তানের দরিদ্র মানুষ এখন চরম মানবিক সংকটের মুখে।
অবশ্য এ পরিস্থিতির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন। তিনি বলেন, পশ্চিমাদের কারণেই আফগানরা এখন ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
সুহাইল শাহিন বলেন, ‘যদি তাঁরা (পশ্চিমারা) বলে যে আফগানিস্তান বিপর্যয়, অনাহার ও মানবিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে এই ট্র্যাজেডি ঠেকানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তাদেরই দায়িত্ব।’
সুহাইল শাহিন আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্যান্য দেশ, যারা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে, আফগানিস্তানের মানবিক সংকটে তাদেরই এগিয়ে আসা উচিত।
আফগানিস্তানের মানবিক সংকটের জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে তালেবান মুখপাত্রের কথা কেউ মানতে পারে, কেউ না-ও মানতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ পর্যবেক্ষক এ বিষয়ে একমত হবেন যে আফগানিস্তানের মানবিক সংকটের সমাধান আন্তর্জাতিক তহবিলের মাধ্যমে আসতে পারে।
কেননা, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশটির অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। দেশটিতে মানবিক সংকট দেখা দেওয়ার পেছনে বিষয়টির দায় রয়েছে।
কোনো কাজ পাওয়ার আশায় কাবুলের সড়কে বসে ছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি হাকিমকে জানান, একসময় ইটভাটায় কাজ করতেন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল ২৫ হাজার আফগানি। কিন্তু এখন তিনি মাসে দুই হাজার আফগানিও আয় করতে পারেন না।
চার সন্তানের এই বাবা হাকিমকে বলেন, তাঁর সন্তানেরা অসুস্থ। তাদের চিকিৎসা করানো বা ওষুধ কেনার মতো অর্থ তাঁর হাতে নেই।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতে হতাশ হয়ে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না। গরিব পরিবারগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’
বিবিসি অবলম্বনে অনিন্দ্য সাইমুম