ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে কিম জং–উন আসলে কী চান

ফাইল ছবি: রয়টার্স
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উত্তর কোরিয়া চলতি মাসে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কিছুটা হলেও জাপানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে এবারের এসব পরীক্ষা ২০১৭ সালের আগস্টের চেয়ে ভিন্ন। সে সময় জাপানিদের ঘুম ভেঙে ছিল সাইরেনের শব্দে। কারণ, কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়াই উত্তর কোরিয়া জাপানের ওপর দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। জাপানিদের কাছে এটি ছিল চরম ধৃষ্টতা।

তবে এবার উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো স্বল্পপাল্লার। এগুলো সাগরে জাপানি উপকূল থেকে অনেক দূরে পড়ছে। মনে হতে পারে কিম জং–উন এখনকার মতো জন্য কিছুটা লাগাম টেনে ধরেছেন। তবে তাঁর চাওয়া পূরণ না হলে এই লাগাম বেসামাল হয়ে পড়ে পারে।

এখন প্রশ্ন কিম জং–উন কী চান। সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর অর্থ হলো উত্তর কোরিয়া দ্রুত একটি পরিপূর্ণ ও কার্যকর পারমাণবিক প্রতিরোধকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক একজন নৌ কমান্ডার অধ্যাপক কিম ডং ইয়ুপ বলেন, ‘আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই হওয়ার কথা ছিল। আমরা অবাক হচ্ছি, কারণ আমরা উত্তর কোরিয়ার প্রযুক্তিকে ছোট করে দেখেছি এবং ধরে নিয়েছি দেশটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আসলে আমরা যা ধারণা করেছি, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে উত্তর কোরিয়া তার সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

উত্তর কোরিয়া চলতি মাসে ছয় দফায় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে ৫ ও ১০ জানুয়ারির পরীক্ষার পর পিয়ংইয়ং দাবি করেছে যে তারা সফলভাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এর মানে হলো উত্তর কোরিয়া এমন প্রযুক্তি তৈরি করছে, যা ওই অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের ব্যয়বহুল ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাকে হারিয়ে দিতে পারে।

দ্য সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরির দায়েউন কিম বলছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে তারা এমন অস্ত্র তৈরি করতে চায়, যা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে জটিল করে তুলতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চিহ্নিত করা কঠিন হবে।’

অধ্যাপক কিম ডং ইয়ুপ দায়েউনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন,‘উত্তর কোরিয়া আসলে চাইছে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে নড়বড়ে করে দিতে। তারা এমন পদ্ধতি তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করতে চাইছে, যা একদিকে শত্রুকে আক্রমণ করবে, আবার নিজেকে প্রতিরক্ষা দিতেও সক্ষম হবে।’
অধ্যাপক কিম বলছেন, উত্তর কোরিয়ার মূল লক্ষ্য হামলা করা নয়, বরং নিজেদের রক্ষা করা এবং দেশটি এই সক্ষমতায় বৈচিত্র্য আনতে চাইছে।

উত্তর কোরিয়াকে পর্যবেক্ষণ যারা করেন, তাদের মধ্যে বড় অংশই এই ধারণা পোষণ করেন। তবে দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে হামলা হলে প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক সক্ষমতাকে কার্যকর প্রতিরোধকে রূপান্তর থেকে বহু দূরেই আছে উত্তর কোরিয়া। যদিও দেশ দুটি বারবার বলেছে উত্তর কোরিয়ার বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতের বা হামলার কোনো লক্ষ্য তাদের নেই।
এরপরও ছোট ও গরিব এই দেশটি কেন তার জিডিপির এক–চতুর্থাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে চলেছে।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ অঙ্কিত পান্ডা বলেন, এমনও হতে পারে যে দেশটির সম্পর্কে বাইরের মানুষ যা মনে করে, বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত। উত্তর কোরিয়া মনে করে যে নিজেকে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র এখনো তাদের নেই।

অঙ্কিত বলেন, ‘কিম জং-উন দিনকে দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন। আমার মনে হয়, তিনি চীন বা রাশিয়াসহ কাউকেই বিশ্বাস করেন না। সে কারণেই হয়তো মনে করছেন যে তাঁর সক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে নিতে হবে, আমরা যথেষ্ট হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।’

তবে অনেকেই অঙ্কিতের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরের দংসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রিয়ান আর মিয়ার্স বলেন, পিয়ংইয়ংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পকে আরও উন্নত করা।
তিনি মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তির আলোচনায় ও কোরিয়ান উপত্যকা থেকে মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহারে তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের আর কোনো বাধা থাকবে না।

এ ছাড়া অল্প সময়ের জন্য উত্তর কোরিয়ার আরেকটি পরিকল্পনা রয়েছে। তারা চায় পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জের ধরে জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাক। আর এটি করতে হলে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অন্তর্ভুক্তি দরকার।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, পিয়ংইয়ং সংকট তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। এবারও এমনটাই মনে করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।

দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সদস্য প্রফেসর কিম ইয়াংজুন বলেন, ‘ব্যাপারটি খারাপ হলেও এটা আমার কাছে ভালো লক্ষণ।’ শান্তি উদ্যোগের আগে কিম জং-উন সর্বোচ্চ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাতে চান। এর মধ্য দিয়ে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জরুরি ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ রোড ম্যাপসহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরুর চাপ তৈরি করতে চাচ্ছেন। আর সেটি হলে সম্ভবত তাঁকে হতাশই হতে হবে। প্রথমত, জো বাইডেন এখন ব্যস্ত ইউক্রেন সংকট নিয়ে। দ্বিতীয়ত, পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে নিজেকে জড়িত করার খুব একটা ইচ্ছা তাঁর নেই।

অঙ্কিত পান্ডাও মনে করেন, উত্তর কোরিয়া নিজেদের আলোচনায় অগ্রাধিকারের তালিকায় দেখতে পছন্দ করে। তবে জো বাইডেনের কাছে কিম জং–উন একজন অত্যাচারী শাসক। তাই রাজনৈতিক দিক থেকে উনের কাছ থেকে বাইডেনের তেমন কিছু পাওয়ার নেই।

বিবিসি থেকে অনুবাদ: লিপি রানী সাহা