ফুকুশিমা বিপর্যয়ের এক দশক

‘কোনো মানুষই নেই, রয়ে গেছে শুধু শহরটি’

জাপানে ১০ বছর আগে ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রাণ হারানো লোকজনের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এক ব্যক্তি। আজ ফুকুশিমায়
ছবি: রয়টার্স

১০ বছর আগে জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয়ে মাসাকাজু দাইবুর পরিবারে নেমে এসেছিল অন্ধকার। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়া থেকে বাঁচতে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারটি। গত বছর বাড়িতে ফিরেছেন দাইবু। আবার চালুও করেছেন পারিবারিক রেস্তোরাঁটি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ক্রেতা খুঁজে পান না। ভয়ে বেশির ভাগ লোক এলাকায় না ফেরায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

৬৫ বছর বয়সী দাইবু এএফপিকে বলেন, ‘কোনো মানুষই নেই। শুধু রয়ে গেছে শহরটি। এটি আসলে একটি সিনেমার দৃশ্যের মতো। আমি কোনো মানুষের মুখের শব্দ শুনতে পাই না। শুধু বন্য কুকুর, গরু ও শূকরের ডাকাডাকির শব্দ শুনতে পাই।’

২০১১ সালে ১১ মার্চ জাপানে রিখটার স্কেল ৯ মাত্রার ভূমিকম্প এবং এর জেরে সুনামি আঘাত হানে। এতে সমুদ্রের পাশে অবস্থিত ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নামের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ কারণে কয়েকটি রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত চুল্লি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এতে নিহত হওয়ার খবর জানা না গেলেও পারমাণবিক কেন্দ্রটির অন্তত ১৬ কর্মী আহত হন। সুনামি ও ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় ১৮ হাজারের বেশি মানুষ। জাপানের মানুষ প্রতিবছর দিনটি নানা আচার–অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর ফুকুশিমার ১২ শতাংশ এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় বাড়িঘর ছাড়ে অথবা কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্ধার করে। ব্যাপক আকারে তেজস্ক্রিয়তা নিষ্ক্রিয়করণ কার্যক্রম পরিচালনার পর অনেক এলাকাকে নিরাপদ ঘোষণা করা হয়। বাড়িঘরে ফিরে যেতে অনেক আর্থিক সুবিধার ঘোষণা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু এরপরও অনেকে ঘরে ফিরতে ইচ্ছুক নয়। তাদের একটাই ভয়—তেজস্ক্রিয়তা।

মাসাকাজু দাইবুর বাড়ি নামি শহরে। যে পারমাণবিক চুল্লিতে বিপর্যয় ঘটে, তার নয় কিলোমিটার দূরে এটি। শহরটিতে দাইবুর দাদা রেস্তোরাঁটি চালু করেছিলেন। পারমাণবিক চুল্লির আশপাশের বিচ্ছিন্ন এলাকার কিছু অংশ নামিসহ ১২টি এলাকা। কয়েক বছর ধরে দাইবু নিজের এলাকায় শুধু সংক্ষিপ্ত সফর করতে পারতেন। এখন স্ত্রীসহ ফিরে গেছেন জন্মস্থানে।

পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর পুরো এলাকা তেজস্ক্রিয়তায় ঢেকে যায়। এ কারণে দাইবুও সবকিছু বন্ধ করে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, ঘরের ভেতরের সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদের মতো দাইবু ও তাঁর স্ত্রীও সন্দেহে ছিলেন জন্মস্থানে আর ফিরবেন কি না। ২০১৭ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর ওই দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন, অতীতকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবেন তাঁরা।
দাইবু এখনো আশাবাদী, আগের মতো প্রাণ ফিরে পাবে শহরটি। আবার প্রতিবেশীতে ভরে যাবে প্রাঙ্গণ। জীবনের অন্তিমে এসে সেটাই দেখে যেতে চান তিনি।

টিকে থাকাই এখন বড় বিষয়

দাইবুর পদাঙ্ক অনুসরণ করার মতো মানুষের সংখ্যা নেহাত কম। নামি শহরের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক বিপর্যয়ের আগে শহরটিতে ২১ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। এখন এর জনসংখ্যা আগের মাত্র ৭ শতাংশ। ভাড়া কমানোসহ অনেক আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা করা হলেও মানুষ আর নামিমুখী হচ্ছেন না। এসব মানুষের কাছে টিকে থাকাই এখন বড় বিষয়।
শহরটির ৩৬ শতাংশ বাসিন্দার বয়স ৬৫ বা এর ওপরে। মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী স্থানীয় এলিমেটারি ও জুনিয়র হাইস্কুলে নিবন্ধনভুক্ত, যা আগে ছিল প্রায় ১ হাজার ৮০০। পুরো জাপান জন্মহার কম ও বয়স্ক জনসংখ্যার সমস্যায় পীড়িত। পারমাণবিক দুর্ঘটনার কারণে নামির অবস্থা আরও খারাপ। তবে শহরটিতে জনসংখ্যা বাড়াতে পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০৩৫ সালের মধ্যে শহরটির জনসংখ্যা আট হাজারে উন্নীত করার আশা করছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে বসবাসের জন্য প্রতিটি নতুন পরিবারকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ ইয়েন (১৮ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। শহরের কর্মকর্তা তাকানোরি মাতসুমোতো বলেছেন, গোষ্ঠী হিসেবে টিকে থাকাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয়।

‘ফিরতে পারি না’

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারকাজ এখনো চলছে। কেন্দ্রটির তেজস্ক্রিয়তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়করণের সময়সীমা রয়েছে ২০৪১ সালের প্রথম দিকে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে সেই কাজ সম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে রয়েছে সন্দেহ। এ কারণে অনেকের মধ্যে ভয় কাজ করে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে। এ ছাড়া সরকারের তেজস্ক্রিয়তা নিষ্ক্রিয়করণের প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
বিপর্যয়ের সময় তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন মেগুমি ওকাদা। বর্তমানে রাজধানী টোকিওতে বসবাস করা এই মা তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কায় ফিরে যেতে ভয় পান। তিনি বলেন, ‘এমন নয় যে আমি ফিরে যেতে চাই না। আমি ফিরে যেতেই চাই। কিন্তু যেতে পারি না। আমি যদি একা হতাম, তাহলে আমি ফিরে যেতাম।’
জাপানের কুয়ানসেই গাকুইন ইউনিভার্সিটির গবেষকদের ২০২০ সালের একটি জরিপমতে, ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ জন্মস্থানে ফিরতে চায় না। জরিপে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ইয়োকো সাইতো বলেছেন, অনেক মানুষ বলেছেন, সরকারের নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে তাঁদের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস রয়েছে।

হতাশা ও একাকিত্ব

যাঁরা ফিরে গেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে হতাশা ও একাকিত্ব পেয়ে বসেছে। সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর ফুকুশিমা অঞ্চলের মিনামিসোমায় ফিরে গেছেন তাকায়ো কোহাতা নামের এক বৃদ্ধ। তিনি ভয়ে আছেন, কবে না আবার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। ওই অঞ্চলের খাবারে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ আছে কি না, তা কঠোরভাবে পরীক্ষাও করে দেখেন কর্মকর্তারা। এরপরও খাবার নিয়ে শঙ্কা কাটছে না স্থানীয় লোকজনের মধ্যে।
তাকায়ো বলেন, ‘আমার চার সন্তান। তেজস্ক্রিয়তার ভয়ে সন্তানেরা আমাকে দেখতে আসে না। আমি তাঁদের আশঙ্কার কথা বুঝি। কিন্তু এ কারণে আমাকে হতাশা ও একাকিত্ব গ্রাস করেছে।’