আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে গত বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। আত্মঘাতী হামলাকারী কীভাবে বিমানবন্দরের আবে গেটের কাছে গিয়েছিলেন, ঠিক কোন সময়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
নিউইয়র্ক টাইমসের ওই খবরে জানা যায়, বিমানবন্দরের আবে গেটে ঢোকার জন্য তখন হুড়োহুড়ি চলছিল। তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া লোকজনের ভিড় ছিল সেখানে। মার্কিন সেনাবাহিনী ও অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা সেই ভিড় সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবারের এমন দৃশ্য অবশ্য নতুন ছিল না।
বিমানবন্দরের তিনটি গেটে দুই সপ্তাহ ধরে এক লাখের বেশি আফগান ভিড় করেছিল। তারা সবাই দেশ ছেড়ে পালাতে বিমানবন্দরে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি করছিল। সেই ভিড় সামলাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন পাঁচ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা। মার্কিন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা পরিস্থিতি সামলাতে দুটি গেট বন্ধ করে দেয়। তবে আবে গেটটি খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তিনটি প্রশ্ন ভাবাচ্ছে পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের। প্রথমত, নিরাপত্তাকর্মীরা এত কাছাকাছি ছিল কেন? দ্বিতীয়ত, বিমানবন্দরের বাইরে থাকা তালেবানের তল্লাশিচৌকিতে বোমা হামলাকারী ধরা পড়লেন না কেন। আর তৃতীয়ত, তালেবানের তল্লাশিচৌকির কেউ হামলাকারীকে কৌশলে ছেড়ে দিয়েছিলেন কি না?
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ওই হামলার এক দিন আগেই সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানবন্দরের তিনটি গেটে হামলার আশঙ্কার কথা জানায় তারা। আবে গেটও সম্ভাব্য হামলার ওই তালিকায় ছিল।
তখন পড়ন্ত বিকেল। ঘড়িতে ৫টা বেজে ৪৮ মিনিট। হামলাকারী পোশাকের নিচে ২৫ পাউন্ড ওজনের বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখেছিলেন। হামলাকারী হেঁটে যাচ্ছিলেন আবে গেটে থাকা মার্কিন সেনাদের দিকে।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, তল্লাশি করার আগপর্যন্ত হামলাকারী অপেক্ষা করছিলেন। মার্কিন সেনারা তল্লাশি শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটান ওই হামলাকারী। আত্মঘাতী হামলায় সাধারণত যে ধরনের বোমা ব্যবহৃত হয়, এটি ছিল তার চেয়ে অনেক বড়। বিস্ফোরণ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গেই হামলাকারী মারা যান। ওই বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ১৭০ জন মারা গেছেন। হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ জন সেনাও রয়েছেন।
বিমানবন্দরের গেটে মার্কিন বাহিনী ও আফগানদের মুখোমুখি অবস্থানের কথা উল্লেখ করে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল কেনেথ ম্যাকেনজি বলেন, পরিস্থিতি যুদ্ধের মুখে পড়ার মতো। বিমানবন্দরে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার আগে আফগানদের অবশ্যই তল্লাশি করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে যেকোনো সময় মার্কিন বাহিনী হামলাকারীর সম্মুখীন হতে পারে।
পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার আবে গেটে যে হামলার ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। তাঁরা ঘটনাগুলো একের পর এক সাজিয়ে তথ্য তুলে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, সে সময় আসলে ঠিক কী ঘটেছিল। তিনটি প্রশ্ন ভাবাচ্ছে পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের। প্রথমত, নিরাপত্তাকর্মীরা এত কাছাকাছি ছিল কেন? দ্বিতীয়ত, বিমানবন্দরের বাইরে থাকা তালেবানের তল্লাশিচৌকিতে বোমা হামলাকারী ধরা পড়লেন না কেন। আর তৃতীয়ত, তালেবানের তল্লাশিচৌকির কেউ হামলাকারীকে কৌশলে ছেড়ে দিয়েছিলেন কি না?
কাবুলের চিকিৎসা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিমানবন্দরের বাইরে হামলায় এ পর্যন্ত ১৭০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনার পর গতকাল শুক্রবার বিমানবন্দরের বাইরে আফগানদের ভিড় তুলনামূলক কম দেখা গেছে। হামলার পর বিমানবন্দর এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। তবে আফগানিস্তান থেকে মানুষকে সরিয়ে নিতে ফ্লাইট চালু রয়েছে।
গতকাল স্থানীয় সময় বেলা দুইটার পর মার্কিন উড়োজাহাজে ১৩ মার্কিন সেনার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার পর ইনস্টাগ্রামে শোক জানান নিহত মার্কিন সেনার স্বজনেরা।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বোমা হামলার পরই বিমানবন্দরের কাছে তালেবান গুলি ছোড়ে। তাঁরা আরও বলছেন, আবে গেটে গুলিতে আহত হতে পারে কয়েক মার্কিন ও আফগান। গেটের কাছে হামলার পর ব্যারন হোটেলে দ্বিতীয় আত্মঘাতী বোমা হামলার কথা জানায় মার্কিন সেনাবাহিনী। তবে প্রাথমিকভাবে দেওয়া ওই তথ্যে অসংগতি খুঁজে পেয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। আঞ্চলিক অপারেশনের জয়েন্ট স্টাফ ডেপুটি ডিরেক্টর মেজর জেনারেল হ্যাঙ্ক টেলর বলেন, দ্বিতীয় আত্মঘাতী বোমা হামলার তথ্য ভুল ছিল।
সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর ২৫ পাউন্ডের বিস্ফোরক বহনের ঘটনা ছিল অবাক করার মতো। আত্মঘাতী হামলাকারীরা সাধারণত ১০ থেকে ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক বহন করে। ২৫ পাউন্ডের বোমা বিস্ফোরণের পর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার আবে গেটে যে সেনারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা মাত্র এক সপ্তাহ আগে কাবুলে আসেন।
মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের জেনারেল কেনেথ ম্যাকেনজি বলেছেন, হামলার পর তাঁরা দমে যাননি। যাঁরা মার্কিন বাহিনীকে সহায়তা করেছেন এবং যাঁরা দেশ ছাড়তে চান, এমন আফগানদের তাঁরা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন। কারণ, আফগানদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালনের জন্যই তাঁরা বিমানবন্দরে রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের আফগানিস্তান শাখা (আইএসকেপি) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা বলেছে, তাদের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আমেরিকান সেনাবাহিনীর অনুবাদক ও দোসরদের ওপর এ হামলা চালিয়েছে।
হামলার নিন্দা জানিয়ে এর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে ১৫ সদস্যের এ পরিষদ এ কাজে সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।