আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। গতকাল বৃহস্পতিবারের এই হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন প্রাণ হারিয়েছে। আইএসের শাখা সংগঠন আইএস-কে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, এই আইএস-কে-এর পুরো নাম ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্স। এই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা আফগানিস্তানের বাইরে পাকিস্তানেও সক্রিয়। ফোর্বসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ঐতিহাসিক খোরাসান অঞ্চলের নাম যুক্ত করে আইএস এই শাখাটির এমন নামকরণ করেছে। ব্রিটানিকা বলছে, এই খোরাসানের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। আজকের ইরান, তুর্কমিনিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে এলাকাটি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএস-কে যাত্রা শুরু করে। বিবিসি বলছে, সেই সময় আইএসের রমরমা সময় যাচ্ছিল। কারণ, এর আগে ২০১৪ সালে সিরিয়া ও ইরাকের এলাকা দখল করে তথাকথিত ‘খেলাফত’ ঘোষণা করেছিল আইএস। ফোর্বস বলছে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানের সদস্যদের নিয়ে আইএস-কে গঠিত হয়েছিল। এই সদস্যরা মনে করেছিল, তালেবান যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী নয় বা তাদের সেই ‘তথাকথিত আদর্শ’ বাস্তবায়নে যথেষ্ট কঠোর নয় তালেবান।
বলা হয়ে থাকে আফগানিস্তানের নানগাহার প্রদেশে আইএস-কে–এর বিচরণ। এ ছাড়া দেশটির উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় তাদের ঘাঁটি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের ফেলো বিল রোজিও ফোর্বসকে বলেন, এসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় তাদের। তবে সে লড়াই চালিয়ে সফল হয়েছিল আইএস-কে। এসব এলাকার বাইরেও তাদের বিচরণ রয়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকাতেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে। এর আগেও আইএস-কে কাবুলে হামলা চালিয়েছে। ২০২০ সালের মে মাসে কাবুলের হাসপাতালে হামলা চালিয়েছিল তারা। এ ছাড়া চলতি বছরের মে মাসে কাবুলে মেয়েদের একটি স্কুলে হামলা চালিয়েছিল আইএস-কে। দুই হামলাতেই বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিল। আর সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার কাবুলের বিমানবন্দরে হামলা চালাল তারা। বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, নানগাহার ছাড়াও আইএস-কে-এর ঘাঁটি রয়েছে আফগানিস্তানের কুনার ও নুরিস্তান প্রদেশে।
বিবিসি বলছে, আফগানিস্তানে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী এখন সক্রিয় রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস এই আইএস-কে। স্কুলগামী মেয়েশিশু, হাসপাতাল, এমনকি হাসপাতালের প্রসূতি ইউনিটে হামলা চালিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও হত্যা করেছে আইএসের এই শাখার জঙ্গিরা। বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, তাদের স্লিপার সেল রয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। এই বার্তা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মসজিদ-মাজারে হামলা চালিয়েছে আইএস-কে। মুসলমানদের মধ্যে যারা সুন্নি নয়, তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এই সংগঠনটি।
তবে বিভিন্ন এলাকায় আইএস-কে নৃশংস হামলা চালালেও খুব বেশি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এরপর নিজেদের হামলার ধরন বদলে ফেলে আইএস-এর এই শাখা। বিভিন্ন শহর বা এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আইএস-কের জঙ্গিরা ঘাপটি মেরে থাকে। এরপর তারা পরিচিত ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালিয়ে থাকে।
বিবিসি বলছে, যখন আইএস-কে-এর রমরমা অবস্থা ছিল, তখন তাদের জঙ্গির সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের মতো। আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ও তালেবানের হামলায় তাদের অনেক সদস্য মারা গেছে। ফলে তাদের সদস্যসংখ্যা কমেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন জাতিসংঘকে গত বছরের জুনে বলেছিল, আইএস-কে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা তালেবান ও অন্যান্য সংগঠন থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে। তবে এই পদক্ষেপ সফলতা পায়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এএফপি বলছে, আইএস-কে নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে গত মাসে। তাতে বলা হয়েছে, তাদের সদস্যসংখ্যা এখন পাঁচ শর কাছাকাছি।
এদিকে ফোর্বসের হিসাব বলছে, তালেবানের তুলনায় আকারে অনেক ছোট আইএস-কে। তাদের সদস্যসংখ্যা পনেরো শ থেকে দুই হাজারের মধ্যে। কিন্তু এর তুলনায় তালেবানের সংখ্যা অনেক বেশি। মার্কিন সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, তালেবানের সদস্যসংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি।
সিএনএন বলছে, তালেবানর জাত শত্রু আইএস-কে। ফোর্বসও একই কথা বলছে। কিন্তু বিবিসি বলছে ভিন্ন কথা। এই সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আইএস-কে। সেই সংগঠনটি হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালেবানেরও নেতা।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করছেন সাজান গোহেল। আফগানিস্তানের জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। তাঁর কথায়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু হামলা তালেবানের হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও আইএস-কে একসঙ্গে চালিয়েছে।
আইএসের সঙ্গে আইএস-কে-এর যে সম্পর্ক রয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ মেলে তালেবানের সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে। ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পুল-ই-চরকি কারাগারের তালা খুলে দেয় তারা। সেই কারাগারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আল-কায়েদা ও আইএসের সদস্য। এ থেকে বিশ্লেষকদের অনুমান, ভেতরে–ভেতরে তালেবানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে আইএসের এই শাখার।