কাজাখস্তানে চলমান বিক্ষোভ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে সেখানে এখন অবস্থান করছে রুশ নেতৃত্বাধীন আড়াই হাজার সেনা। কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও) জোটের সেনা তারা। ১৯৯৯ সালে সিএসটিও প্রতিরক্ষা চুক্তি করা হলেও এত দিন এর আওতায় যৌথ সেনা মোতায়েনের ঘটনা দেখা যায়নি। তবে এখন এ সামরিক জোট নিজেদের একটি সদস্যদেশের (কাজাখস্তান) অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা মোকাবিলার জন্য সেনা পাঠিয়েছে। এ জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। কী উদ্দেশ্যে দেশটি কাজাখস্তানে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল, বিনিময়ে তারা কী আশা করছে, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনা মোতায়েনের এ ঘটনায় অনেকে ১৯৬৮ সালে প্রাগে এবং ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব ধূলিসাৎ করতে সোভিয়েত অভিযানের ‘ভয়ংকর পুনরাবৃত্তির’ আভাস পাচ্ছেন।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্প্রতি কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ট তোকায়েভ রুশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চান। ইতিমধ্যে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রায় আড়াই হাজার সেনা কাজাখস্তানে পৌঁছেছে। গতকাল বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে আলমাতি বিমানবন্দরের পুনর্দখল নিতে কাজাখ সেনাদের সহযোগিতাও করেছে তারা। রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রভুক্ত পাঁচ দেশ ও রাশিয়ার মধ্যকার সামরিক জোটের (সিএসটিও) আওতায় সাময়িকভাবে সেনা মোতায়েন করেছে তারা।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়, কাজাখস্তানে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সিএসটিও জোটের সেনা মোতায়েনের ঘটনায় নতুন করে ওয়ারশ চুক্তির প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ সামরিক চুক্তি নিয়ে একটি কৌতুক প্রচলিত ছিল। বলা হতো, এটিই একমাত্র সামরিক চুক্তি, যার আওতায় চুক্তিভুক্ত দেশগুলো নিজেরাই নিজেদের ওপর হামলা চালায়। ১৯৬৮ সালে প্রাগে সংস্কারপন্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক জোটটির ট্যাংক তুলে দেওয়ার পর থেকে এ ধরনের কৌতুক করা হতো। সিএসটিও মূলত সামরিক জোট হলেও ওয়ারশ চুক্তির সঙ্গে এর সুনির্দিষ্ট একটি মিল রয়েছে। আর তা হলো কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপে করা না করার সিদ্ধান্তটি মূলত মস্কো নেয়।
মস্কোভিত্তিক এমজিআইএমও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক মাক্সিম সাচকভ কাজাখস্তানে রুশ হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। কাজাখস্তানে সেনা পাঠানোর ঘটনাকে ওয়ারশ চুক্তির আওতাধীন অভিযানের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নন তিনি। মাক্সিম সাচকভ একে মিথ্যা প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, স্বল্পমেয়াদি এ মিশনের মধ্য দিয়ে অঞ্চলটিতে নিজেদের অবস্থান জোরালো করতে পারবে রাশিয়া।
এক টুইটার পোস্টে এসব অভিমত ব্যক্ত করেছেন সাচকভ। তিনি বলেন, কাজাখস্তানে সংকটময় পরিস্থিতি চলছে। এ পরিস্থিতি কাটাতে মস্কো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
গতকাল টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁর অনুরোধে রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা অস্থায়ীভাবে কাজাখস্তানে অবস্থান করবে। রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সিএসটিওর এই বাহিনীতে প্রায় আড়াই হাজার সেনা রয়েছে। সেনা পাঠানোর জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘বিশেষ ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন কাসিম তোকায়েভ।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়, পুতিন সম্ভবত আশা করছেন কাজাখস্তানে পাঠানো সেনারা সে দেশে দ্রুত শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। আর তাতে মস্কোর প্রতি কৃতজ্ঞ ও ঋণী থাকবে কাজাখস্তান।
তবে এ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে ঝুঁকিও রয়েছে। কাজাখস্তানে সিএসটিও সেনা মোতায়েনের ঘটনাকে রুশ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অনেকে। কাজাখস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভের মূল অর্জন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ কাজাখদের সঙ্গে রুশ সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বড় ধরনের সংঘাত না হতে দেওয়া।
বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে কাজাখস্তান। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আবার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে কাজাখস্তান। পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজাখস্তানের ভালো সম্পর্কে খুশি নয় মস্কো। এমন অবস্থায় কাজাখস্তানে সেনা পাঠিয়ে দেশটির কাছ থেকে কিছু দাবিদাওয়া পূরণ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে মস্কো।
কাজাখ প্রেসিডেন্ট সিএসটিওর কাছে সেনা চেয়ে পাঠানোর পর পরই রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত সংবাদমাধ্যম আরটির এডিটর ইন চিফ মারগারিতা সিমোনিয়ান তেমন আভাসই দিয়েছেন। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘অবশ্যই আমাদের সহযোগিতা করা উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু শর্ত বেঁধে দেওয়া উচিত।’ তিনি যেসব শর্তের কথা বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তানে রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া এবং ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকার করা।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়, মস্কোতে কেউ কেউ সিএসটিও জোটকে কীভাবে নিচ্ছে, সেটা বোঝার ইশারা হতে পারে এটি। মস্কোর কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে কাসিম তোকায়েভ যদি বিক্ষোভ নস্যাৎ করে দিতে পারেন, তবে বিনিময়ে রাশিয়াও কাজাখস্তান থেকে কিছু আশা করতে পারে।
কাজাখস্তানে চলমান সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলায় রুশ সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় গত শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, কাজাখস্তান কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এ পরিস্থিতির সামাল দিতে পারত। রুশ সেনারা আদৌ কাজাখস্তান ছাড়বে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান যুক্তরাষ্ট্র। ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রুশ সেনারা একবার কোথাও ঢুকলে মাঝেমধ্যে তাদের সেখান থেকে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, যথাযথভাবে বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার সক্ষমতা কাজাখ সরকারের নিজেরই ছিল। আর তেমনটা করা হলে বিক্ষোভকারীদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাও বজায় থাকত। এরপরও কাজাখস্তান কেন রুশ সেনাদের সহযোগিতা চাইল, তা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেন ব্লিঙ্কেন। তিনি বলেন, ‘কেন তারা অন্য দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করল, তা পরিষ্কার নয়। আমরা এ ব্যাপারে আরও জানার চেষ্টা করছি।’