করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামছেই না। এরই মধ্যে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করলেন বিজ্ঞানীরা। চীনের উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলেছেন, দেশটি প্রথম ধাক্কা সামলে উঠেছে। কিন্তু সেখানে এখন আবার সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করেছে। এ ছাড়া হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে প্রথম দিকে সংক্রমণ ততটা না ছড়ালেও এখন বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলা এবং পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারের অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য চীনের শীর্ষস্থানীয় একজন শ্বাসতন্ত্রের রোগবিশেষজ্ঞ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ এই মহামারির বিস্তার কমতে শুরু করবে।
হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীনের শীর্ষ শ্বাসতন্ত্রের রোগবিশেষজ্ঞ ঝং নানশান বলেছেন, ‘সব দেশই যেহেতু জোরদার ও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, কাজেই আমার বিশ্বাস, এপ্রিলের শেষ নাগাদ করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ করোনা মহামারি মোকাবিলায় চীনের সরকারকে পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ঝং নানশান। চীনের শেনজেন টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই আশাবাদের কথা জানান। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এপ্রিলের পর কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। হতে পারে আগামী বসন্তে আরেক দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, অথবা পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে।
চীনের উহানে গত ৩১ ডিসেম্বর অজ্ঞাত কারণে মানুষের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ৯ জানুয়ারি নতুন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করে চীনের বিজ্ঞানীরা জানান, এটি সার্স রোগ ছড়ানো সার্স-করোনাভাইরাসের গোত্রের। এর দুই দিনের মাথায় নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর দ্রুতই ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১১ মার্চ একে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে সংস্থাটি।
চীন সরকারের দেওয়া তথ্যমতে, মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে গোটা দেশে স্থানীয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। কিন্তু বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীনা কর্তৃপক্ষ বিদেশি নাগরিকদের দেশটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বিদেশফেরত চীনা নাগরিকদেরও বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় করোনার সংক্রমণের সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তথ্যমতে, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চীনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৫০৯। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩ হাজার ৩২৬ জন। সুস্থ হয়েছেন ৭৬ হাজার ৭৬০ জন। ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে দেশটিতে এক দিনে সর্বোচ্চ নতুন রোগী শনাক্ত হন ১৪ হাজার ১০৮ জন। এরপর সংক্রমণ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গত ১৮ মার্চ দেশটিতে প্রথমবারের মতো স্থানীয়ভাবে কোনো সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। পরপর কয়েক দিন নতুন করে কেউ শনাক্ত হয়নি। চীনে গতকাল নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩১ জন। আরও মারা গেছেন ৪ জন।
>চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে সংক্রমণ বাড়ছে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে
নেচার সাময়িকীর অনলাইনে গত সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে সংক্রমণ কমে আসায় এখন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে, কাজে যোগ দিচ্ছে। এই অবস্থায় হংকংয়ের ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল লিউং মনে করেন, একবার লকডাউন বা অবরুদ্ধ করে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা হয়তো সম্ভব নয়। করোনা রুখতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, একটা দেশের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হলে তাঁদের শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা। এমনটা হলে ভাইরাসটি আবার ছড়িয়ে পড়া কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু যে উহানে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেন, সেখানে কিন্তু সেরে ওঠা রোগীদের ৯০ শতাংশের বেশি আবার সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। তার মানে, করোনা ঠেকাতে প্রতিষেধকই অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু প্রতিষেধক উদ্ভাবনে আরও এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের রোগবিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু টাটেম বলেন, কড়াকড়ি শিথিল করলে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা বুঝতে হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, হংকংয়ে গতকাল পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত রোগী ছিলেন ৮৪৫ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪ জন। তবে চীনের আধা স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলে নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৪৩ জন। অথচ চীনের বাইরে যখন বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছিল, সে সময়ও এই অঞ্চলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০-এর কম। সাম্প্রতিক সময়ে তা বাড়তে শুরু করে। সিঙ্গাপুরে গতকাল পর্যন্ত সংক্রমিত রোগী ছিলেন ১ হাজার ১১৪ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ জন। গতকাল নগররাষ্ট্রটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৬৫ জন। এর আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার শনাক্ত হয়েছেন ৩৯ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল দেশটির সরকার সামাজিক দূরত্বের নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত।
তাইওয়ানের অবস্থা তুলনামূলক এখনো ভালো। তবে এখানেও সংক্রমণ বাড়ছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, এই দেশে গতকাল পর্যন্ত সংক্রমিত রোগী ছিলেন ৩৪৮ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ জন। গতকাল নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৯ জন।
হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই অঞ্চলগুলোতেও এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বিদেশফেরত ও ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে। এ কারণে তিন অঞ্চলই আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বিদেশফেরত নিজেদের নাগরিকদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখছে। এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের অ্যান্ড্রু টাটেম বলেন, অতিসতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে এবং অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি চালাতে হবে। অবরুদ্ধ অবস্থা খুব ধীরে ধারাবাহিকভাবে শিথিল করতে হবে। না হলে সংক্রমণ আবারও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের রোগতত্ত্ববিদ বেন কাওলিং বলেন, চীন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। দ্রুততর সময়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল নির্মাণ করেছে। এতেই থেমে থাকেনি তারা। ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করেছে তারা। চিকিৎসাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন। কারও জ্বর পেলেই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, এই অতি তৎপরতার কারণেই তাঁরা ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। অন্য দেশগুলোও এখন চীনকে অনুসরণ করছে। তবে চীন যেভাবে কাজটা করেছে, তারা সেভাবে পারছে না। কাওলিং বলেন, ‘আমাদের দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে।’