করোনার ঢেউ মোকাবিলার সক্ষমতা কি রয়েছে উত্তর কোরিয়ার

করোনা মহামারি শুরুর পর কিম জং-উনকে কখনো মাস্ক পরা অবস্থায় দেখা যায়নি। সম্প্রতি তাঁকে টেলিভিশনে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখা যায়
ছবি: এএফপি

উত্তর কোরিয়ার কোনো নাগরিক করোনায় আক্রান্ত হননি বলে দুই বছর ধরে দাবি করে আসছিল দেশটির সরকার। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস শনাক্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে দেশটি। সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানায় তারা। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করে উত্তর কোরিয়া সরকার।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, দেশটি এই খারাপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কি না। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্যসেবার দেশগুলোর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একটি। দেশটির পুরো জনগোষ্ঠী এখনো করোনার টিকার বাইরে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, করোনার এই প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হবে দেশটিকে। এ পরিস্থিতিতে এএফপির বিশ্লেষণে ওঠে এসেছে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন।

স্বাস্থ্যসেবা কেমন?

বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্যসেবার দেশগুলোর একটি উত্তর কোরিয়া। ২০২১ সালে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায়, ১৯৫ দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান ছিল ১৯৩ নম্বরে।

কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, উত্তর কোরিয়ায় সবার জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, উত্তর কোরিয়ানদের দীর্ঘদিন ধরে জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য অর্থ পরিশোধ করে হয়, সাধারণত সিগারেট বা অ্যালকোহলের কারণে রোগে আক্রান্ত হলে।

উত্তর কোরিয়ার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান লিবার্টির সোকিল পার্ক বলেন, শরণার্থীদের বর্ণনায় বরাবরই হাসপাতালের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে। তিনি আরও বলেন, রোগীর স্বজনদের কালোবাজার থেকে ওষুধ ও অন্যান্য পথ্য কিনতে হয়েছে। চিকিৎসকদের জীবিকা নির্বাহ করতে নিয়মের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।

পিয়ংইয়ংয়ের স্টেশনের সামনে মাস্ক পরে হাটছেন লোকজন

লোকজন কি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী?

উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যসংকটে ভুগছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, গত বছর দেশটি ‘খাদ্যসংকটের’ মুখোমুখি হয়েছিল। আর জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছিলেন, খাদ্যসংকটে পড়া লোকজন অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ গবেষক লিনা ইয়োন বলেন, উত্তর কোরিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ব্যাপক অপুষ্টিতে ভোগে। করোনার কারণে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার দুই বছর পর দেশটিতে এখন নামমাত্র ওষুধ আছে।

উত্তর কোরিয়ার জনগণের স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৮ সালে জানায়, উত্তর কোরিয়ায় ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে ৮৪ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। আগে থেকেই যে দেশের এই অবস্থা, সেখানে করোনা একটি বড় ঝুঁকি।

উত্তর কোরিয়ার পক্ষত্যাগ করে পালিয়ে এসে গবেষক হওয়া আহন চ্যান-ইল বলেন, দুর্বল স্বাস্থ্য, বিশেষ করে ব্যাপক অপুষ্টি উত্তর কোরিয়াকে করোনার জন্য উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলেছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় কি প্রস্তুত দেশটি?

দুই বছর আগে উত্তর কোরিয়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যও বন্ধ করে দেয়। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট স্থগিত করে এবং চীন থেকে অবৈধভাবে কেউ এলে তাকে গুলি করে হত্যার আদেশ জারি করে।

পিয়ংইয়ং দাবি করেছে, তাদের এই কঠোর পদক্ষেপের কারণে ভাইরাসটিকে উত্তর কোরিয়া থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে দেশটি কোনো টিকা কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।

গরিব দেশটি গত বছর চীনের তৈরি করোনা টিকার ৩০ লাখ ডোজ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সেগুলো ‘বেশি প্রয়োজন এমন দেশগুলোকে’ দেওয়ার পরামর্শ দেয়।
শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্সের মাধ্যমে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাও প্রত্যাখ্যান করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগের কারণে দেশটি এমনটা করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, উত্তর কোরিয়া ও ইরিত্রিয়া—বিশ্বের এই দুটি দেশ করোনা টিকা কর্মসূচি গ্রহণ করেনি।

প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে কি?

চলতি সপ্তাহে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়া করোনা সংক্রমণ নির্ণয় করতে ‘কঠোরভাবে জিনগত বিন্যাস বিশ্লেষণ’ ব্যবহার করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির করোনা পরীক্ষা করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।

গবেষকেরা বলেছেন, দেশটিতে কোয়ারেন্টিনের সুবিধার অভাব রয়েছে। করোনার এমআরএনএ টিকা বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় কোল্ডস্টোরেজেরও ঘাটতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে উত্তর কোরিয়ার ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্ভবত তা সামাল দিতে পারবে না—সেই আশঙ্কা থেকেই দেশটির সরকার টিকাদান কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেছে।

টিকাদানের কার্যকারিতা নির্ভর করে একজন ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অবস্থার ওপর। এর মানে হলো টিকাদান ও ওষুধের পাশাপাশি দেশটির খাদ্যসহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব কি দেশটিকে সহায়তা করতে পারবে?

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবিলম্বে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। সিউলের নতুন সরকারও টিকা পাঠাতে প্রস্তুত। কিন্তু দেশটিতে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই তিনটি নিষিদ্ধ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। কিম জং-উন জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা তাঁরা চান না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব শিগগির তাদের বিকল্প থাকবে না।

দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, গত এপ্রিলে প্রথম ‘জ্বর’ ধরা পড়ে। আর ১২ মের মধ্যে উত্তর কোরিয়ায় নতুন করে ১৮ হাজার শনাক্ত হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব নর্থ কোরিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক ইয়াং মো-জিন বলেন, ইংরেজি ভাষার সংবাদমাধ্যমে এই পরিস্থিতির বিস্তারিত জানানোর মধ্য দিয়ে দেশটি তাদের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা জানান দিচ্ছে। ইয়ং এএফপিকে বলেন, এর মধ্য দিয়ে দেশটি পরোক্ষভাবে এই বার্তা দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে তারা যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে টিকা দেওয়ার অনুরোধ জানাবে।