এশিয়ার চোখজুড়ানো ছয় রেলপথ

করোনাভাইরাসের এই মহামারিকালে অনেক কিছুই থমকে গেছে। অনেকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। দূরে পছন্দের গন্তব্যে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেননি অনেকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভ্রমণ আটকে গেছে অনেকের। ফলে অনেক ভ্রমণপিপাসু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পক্ষে। এ জন্য নিজেদের ভ্রমণের ধরন সম্পূর্ণরূপে বদলে ফেলার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।

কার্ড সেবা ও ট্রাভেলার চেকের জন্য বিশ্বখ্যাত আমেরিকান এক্সপ্রেসের (এমেক্স) সেবা নেওয়া বিশ্বের আট হাজার ভ্রমণকারীকে নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। গ্লোবাল ট্রাভেলার ট্রেন্ডস নামে ২০২১ সালের ওই জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৬৮ শতাংশ পর্যটক আরও টেকসই ভ্রমণের পক্ষে। এ ছাড়া ৭৮ শতাংশ বলছেন, মানসিক চাপ কমাতে তাঁরা ভ্রমণ করতে চান। আগের চেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরসুস্থে ভ্রমণের পক্ষে জরিপে অংশ নেওয়া ৬১ শতাংশ মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএন বলেছ, ২০২২ সালে এশিয়ায় ভ্রমণের জন্য যাঁরা মুখিয়ে আছেন, তাঁদের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে ট্রেনভ্রমণ। তাইওয়ানের পাহাড়ের অপূর্ব সব দৃশ্য থেকে ভারতের রাজস্থানের মরু এলাকা দেখতে দেখতে ভ্রমণ করা যাবে। ট্রেনভ্রমণেই এশিয়ার সুন্দর কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ মিলবে।

ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুর, বেলমন্ড ইস্টার্ন অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস

এশিয়ায় পরিচিত ট্রেনগুলোর মধ্যে অন্যতম ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। প্যারিস ও ইস্তাম্বুলের মধ্যে চলাচল করত এই ট্রেন। বলা হয়ে থাকে, দীর্ঘতম রোমান্টিক রেলভ্রমণ পথ ছিল এটি। ১৮৮৩ সালে রেলপথটি চালু হয়। এর পর থেকেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভ্রমণ পথটি। ১২৬ বছর ধরে চলার পর ২০০৯ সালে দীর্ঘ সময়ের এই ট্রেনভ্রমণ অবশ্য বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ট্রেনের বগিগুলো কিনে নেয় বেলমন্ড হোটেল গ্রুপ। বগিগুলো নিয়ে সংস্কার করে প্রতিষ্ঠানটি।

এই বগিগুলো এখন চলাচল করে ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুরে। বেলমন্ডের ইস্টার্ন অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেসে পুরো একটি দিনের জমকালো ও আকর্ষণীয় ট্রেনভ্রমণের স্বাদ উপভোগ করা যেতে পারে এই পথে ভ্রমণ করে। চার দিনের যাত্রা এটি। এই ভ্রমণ পথে কাউয়ি নদী আর কাঞ্চন বুড়ি ও কুয়ালালামপুরে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়। চমৎকার ও সুস্বাদু সব খাবার, প্যানারোমিক জানালা, সুদর্শন চেরি কাঠের দেয়াল ও মালয়েশিয়ান সিল্ক এমব্রয়ডারির জন্য ট্রেনটিকে চলমান একটি হোটেল বলে মনে হয়। ট্রেনের পেছনে পর্যবেক্ষণের জন্য মালবাহী গাড়ি এর আরেকটি বিশেষত্ব। রয়েছে সেগুন কাঠের ডেক। অতিথিরা বেতের চেয়ারে বসে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ করতে পারেন।

সেভেন স্টারস, কিউসু, জাপান

জাপানে রয়েছে বিলাসবহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ ট্রেন সেবা। এই দেশে যদি মনোমুগ্ধকর ও বিলাসবহুল ট্রেন সেবা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে অন্য ট্রেনগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে সেভেন স্টারস।

জাপানের বুলেট ট্রেনের জন্য বিখ্যাত। বিপরীতে, সেভেন স্টার অনেক ধীরগতিতে চলে। এই ট্রেনে চেপে কিউশু দ্বীপের সাতটি এলাকায় পাহাড় ও সমুদ্র দেখার সুযোগ পান ভ্রমণকারীরা। কিউশু দ্বীপটি জাপানের মূল ভূখণ্ডের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত। একে বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার।

ট্রেনটি দেখতে ওয়াইনের মতো লাল। সত্যিকারের জাপানি ফ্যাশনে তৈরি ট্রেনকে মনে হয় শিল্প ও কারুশিল্পের জীবন্ত জাদুঘর। প্রতিটি যাত্রায় ২৬ জন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। ট্রেনটির মোট পাঁচটি বগিতে রয়েছে বিলাসবহুল পাঁচটি স্যুট। কেউ কেউ পেছনের দিকে থাকা বিশেষ ধরনের কামরাগুলোকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলে মনে করেন। ট্রেনের একেবারে পেছনের দিকে থাকা এসব কেবিনে বসে প্যানারোমিক দৃশ্য দেখার সুযোগ রয়েছে। এই ট্রেনের যাত্রাপথও চার দিনের।

ক্যানডি থেকে এল্লা, শ্রীলঙ্কা মেইন লাইন

শ্রীলঙ্কার একসময়ের রাজ্য ক্যান্ডি এবং এলার মধ্যে চলাচল করে শ্রীলঙ্কা মেইন লাইন নামের একটি ট্রেন। এলা হলো শ্রীলঙ্কার দক্ষিণের একটি পাহাড়ি গ্রাম। শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই ট্রেন যাত্রাকে অনিবার্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু ঝুটঝামেলাসহ ভ্রমণে যাঁদের আপত্তি নেই, তাঁদের জন্য শ্রীলঙ্কা মেইন লাইন ট্রেনভ্রমণ উপভোগ্য হতে পারে।

প্রথম শ্রেণির বগিগুলো উজ্জ্বল নীল রঙের। ট্রেনে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সঙ্গে রয়েছে প্যানারোমিক দৃশ্য দেখার জন্য দারুণ কিছু জানালা। পাহাড়ি পথ দিয়ে যেতে যেতে মনোরম সবুজ দৃশ্য, পাথরের তৈরি সেতু, সমুদ্রের সঙ্গে পাহাড়ের সংযোগ, জঙ্গল ও বড় বড় খামারবাড়ি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে বিশেষ এই ট্রেনটিতে।

তবে প্রথম শ্রেণির তুলনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কামরায় মানুষের ভিড় একটু বেশি থাকে। আসন ছাড়া দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীদের জন্য এমনটা হয়। কিন্তু এসব কেবিনেও খোলা ট্রেনের দরজায় পা ঝুলিয়ে অপূর্ব সব দৃশ্য দেখা যায়। টিকিটের দাম মাত্র দশমিক ৮ ডলার থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে এতে একটি দিন কাটানোর জন্য যা দারুণ সুযোগ।

প্যালেস অন হুইলস, রাজস্থান, ভারত

বলা হয়ে থাকে ভারতের রাজস্থানের প্যালেস অন হুইলস ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা তেমন একটা হয় না। পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ করে ট্রেন সেবা দিতে এটি চালু হয়েছিল ১৯৮২ সালে। ট্রেনটি স্বাধীনতার আগে রাজস্থানের রাজপরিবারের সদস্যরা এটি ব্যবহার করতেন। অবশ্য পুরোনো বগিগুলো এখন আর নেই। ২০০৯ সালে সংস্কার করে আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তবে রাজকীয় ঐশ্বর্যের একটা ছোঁয়া এখনো রয়ে গেছে। সিল্ক ও চকচকে কাঠের তৈরি দেয়াল ঢাকার বিশেষ পর্দা রয়েছে প্রতিটি কামরায়। এ ছাড়া রয়েছে অলংকৃত আসবাবপত্র ও রুপার থালাবাসন। এসব দিয়েই ট্রেনের যাত্রী হিসেবে ওঠা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।
খাবার পরিবেশনের জন্য প্যালেস অন হুইলসে রয়েছে পৃথক দুটি কামরা। রাজকীয় একটি স্পা ছাড়াও রয়েছে একটি বার ও একটি লাউঞ্জ। বিলাসবহুল ভ্রমণের অভিজ্ঞতার জন্য যা প্রয়োজন, এই ট্রেনে তার সবই রয়েছে। ট্রেনটিতে অতিথিদের জন্য রয়েছে ১৪টি বগি। পূর্বের প্রিন্সলি স্টেট বিভিন্ন অঞ্চলের নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিটির নামকরণ করা। যখন ট্রেনটিতে থাকার কথা ওঠে, তখন বলাই যায় যে অর্থ খরচ করলে এই ট্রেনে আপনি পাঁচ তারকা একটি হোটেলের সুবিধা পাবেন। চলতে চলতে উপভোগ করতে পারবেন অসাধারণ সব দৃশ্য।

এখানেই শেষ নয়, ট্রেনটির প্রতিটি কামরা অসংখ্য দর্শনীয় বস্তু দিয়ে ভর্তি। এর মধ্যে রয়েছে ঝাড়বাতি, তৈলচিত্র, হস্তশিল্প, জটিল রুপালি সূচিকর্ম, বিলাসবহুল কার্পেট। আরও রয়েছে জিনিসপত্র রাখার ছোট একটি পাঠাগার ও লাউঞ্জ। সুপার ডিলাক্স কেবিন ছাড়া বেশির ভাগ কেবিনে রয়েছে এক জোড়া বিছানা। রানির জন্য যেমন করে বিছানা সাজানো হয়, তেমন করেই এসব বিছানা সজ্জিত।

সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল, এই আট মাস ট্রেনটি চলাচল করে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের উদ্দেশে আট দিনের যাত্রা শুরু হয় দিল্লি থেকে। যাত্রাপথে ঐতিহাসিক স্থান, কেল্লা, বাজার, ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও বড় বড় সব জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পান এই ট্রেনের যাত্রীরা। এ ছাড়া যাত্রাকালে জয়পুর, উদয়পুর, জয়সালমির ও যোধপুর ছাড়াও ওই অঞ্চলটির অসংখ্য ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ পান যাত্রীরা। পুরো যাত্রাপথে ট্রেন চলে ধীরে ধীরে। দিল্লিতে ফেরার পথে শেষবার যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় আগ্রায় তাজমহল দেখার জন্য।

আলিশান ফরেস্ট রেলওয়ে, সেন্ট্রাল তাইওয়ান

চলতি পথে বন, পর্বত ও সমুদ্রের মিশেলে ট্রেনভ্রমণ অভিজ্ঞতা দিতে তাইওয়ানের খ্যাতি রয়েছে। সেখানকার সবচেয়ে সুন্দর রুটগুলোর একটি আলিশান ফরেস্ট রেলওয়ে। শতাব্দী প্রাচীন এই ট্রেনলাইন প্রথমে গাছ-কাঠ পরিবহনে ব্যবহৃত হতো। ১৯৩৩ সালে পর্যটনের জন্য এটি পুনরায় চালু করা হয়। ডিজেলচালিত ট্রেনটি মধ্য তাইওয়ানের চিয়াই শহর থেকে ৪৪ মাইল দূরের আলিশান পাহাড়ে চলাচল করে। এর মধ্যে তাইওয়ানের সবচেয়ে উঁচু স্টেশন চুশান রয়েছে।

ট্রেনটির যাত্রাপথ তিন ঘণ্টার। এই যাত্রাপথে ৫০টির বেশি সুড়ঙ্গ, ৭৫টি সেতু, নদী, জলপ্রপাত, ঘন বনভূমি ও কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের চূড়ার দেখা মেলে। অন্য ট্রেনের চেয়ে এর কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। ট্রেনটির যাত্রীরা যাত্রাপথে স্বাধীনভাবে চারপাশ চক্কর দিতে পারেন। চাইলে কোথাও যেতে পারেন তাঁরা। হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। এর মধ্যে অল্প সময়ের জন্য পাহাড়চূড়ায় মানমন্দিরে দেখা, ওলং চা–বাগানে যাওয়া বা হ্রদের ধারে বনভোজনও করতে পারেন।

দ্য ভিয়েটাজ, ভিয়েতনাম

ভিয়েতনামের রিইউনিফিকেশন এক্সপ্রেসের পর্যটকদের কাছে পরিচিত নাম। দেশটির রাজধানী শহর হ্যানয়ের সঙ্গে দক্ষিণে হো চি মিন শহরের মধ্যে সংযোগকারী এই রেলপথের দূরত্ব এক হাজার মাইল।

৩০ ঘণ্টার যাত্রাপথ এটি। পথে রয়েছে হাই ভ্যান পাস, ল্যাং কো-এর সমুদ্রসৈকত আর বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। ভ্রমণকারীদের মধ্যে যাঁরা আরামদায়ক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে চান, ভিয়েটাজ ট্রেনে তারও ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য গুনতে হবে ৩৫০ মার্কিন ডলার।