এবার রাশিয়াকে গিলে খাবে চীন?

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই চীন-রাশিয়ার ‘দোস্তি’ ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। তবে এখন দুই দেশের মর্যাদার আসন বদলে গেছে। ছবি: এএফপি
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই চীন-রাশিয়ার ‘দোস্তি’ ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। তবে এখন দুই দেশের মর্যাদার আসন বদলে গেছে। ছবি: এএফপি

বছরখানেক ধরে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নিয়ে কাজ করছে চীন। নিন্দুকেরা বলছেন, চীন এটি দিয়ে প্রায় ৭০টিরও বেশি দেশকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মোহে আটকে ফেলছে। এবার বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়াও পা দিয়েছে একই ফাঁদে। তবে কি যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকাতে গিয়ে চীনের হাতের পুতুল হবে রাশিয়া?

চীন-রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক সব সময় ‘আমে-দুধে’ ছিল না। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিল দুই দেশই। সেই সূত্রে একসময় চীন-রাশিয়ার মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে চীনের নেতা মাও সে–তুংয়ের ঘনিষ্ঠতা স্মরণযোগ্য। ওই সময় রুশ ও চীনারা পরস্পরকে ‘আজীবনের ভাই’ বলে মনে করত। তবে স্তালিনের শাসনের অবসানের পর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দিন দিন ধূসর হতে থাকে। চীন তো একপর্যায়ে ঘোষণাই করে দেয় যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘সংশোধনবাদের’ পথে হাঁটছে। সম্পর্কের সেই উত্থান-পতন পরবর্তী কয়েক দশক ধরে চলে। একসময় পতন হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের, ভেঙে যায় বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক ব্লক। এরপর রাশিয়া কার্যত মুখ ফেরায় পুঁজির দিকে। চীনও হাঁটা শুরু করে সেই পথেই। দুই দেশের পথ মিলে যাওয়ার পর থেকেই সম্পর্কে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা।

মূলত একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই চীন-রাশিয়ার ‘দোস্তি’ ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। দুই দেশেরই শত্রু এক, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। আদতে আমেরিকাবিমুখ মনোভাব থেকেই চীন-রাশিয়া নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের ফাঁকফোকর পূরণ করতে সচেষ্ট হয়। তবে এত দিনে দুই দেশের মর্যাদার আসন বদলে গেছে। স্তালিনের সময়কার সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপ আর রাশিয়ার নেই। তখন চীন ছিল ‘ছোট ভাই’, অর্থ-অস্ত্র সব দিক থেকেই। আর এখন চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি, সামরিক শক্তিও প্রতিযোগিতার জন্য যথেষ্ট। এবার তাই রাশিয়াকে হতে হচ্ছে ‘জুনিয়র’! কারণ শুধু অস্ত্র দিয়ে তো আর দেশ চলে না, অর্থ ও ব্যবসা লাগে। তাই ইউয়ান, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলতে চাইছেন সি চিন পিং।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আদতে চীন ও রাশিয়া—দুই দেশেরই শত্রু এক, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকাবিমুখ মনোভাব থেকেই চীন-রাশিয়া নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের ফাঁকফোকর পূরণ করতে সচেষ্ট হয়। ছবি: এএফপি

এবার কিছু নিখাদ তথ্য দেওয়া যাক। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, রাশিয়া দিনকে দিন চীনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। রাশিয়ায় উৎপাদিত কাঁচামালের মূল ক্রেতা চীন। রাশিয়ার জাতীয় তেল কোম্পানি ‘রোজনেফট’ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে চীনা মুদ্রার ওপর। এই কোম্পানিটি তাদের সিংহভাগ তেল রপ্তানি করে চীনে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার দেখতে পারেন না। তাই তাঁর দেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে ইউয়ান দিয়ে। রাশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভের ১৪ শতাংশ বর্তমানে ইউয়ান। থিংক ট্যাংক কার্নেগি মস্কো সেন্টারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্য যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনায় গেলে এই সংখ্যাটি প্রায় ১০ গুণ বেশি। অথচ গত বছর রাশিয়ায় ইউয়ানের রিজার্ভ ছিল মোটের ওপর মাত্র ৩ শতাংশ।

শুধু অর্থ-বাণিজ্যই নয়, চীন হাত দিয়েছে রুশ অস্ত্রাগারেও। নেটওয়ার্কিং ও নিরাপত্তা রক্ষায় পুতিনের জন্য নানা ধরনের ‘অস্ত্র’ বানাচ্ছে চীন। গত মাসেই চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে রাশিয়া। রুশদের ফাইভ–জি প্রযুক্তি দেবে হুয়াওয়ে। আবার সারা পৃথিবীর অভিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে নিজেদের জন্য পৃথক ইন্টারনেট দুনিয়া তৈরিতেও চীনা সাহায্য নিচ্ছে রাশিয়া। চীনা ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা রাশিয়ায় ব্যবসা খুলেছে। ফেস রিকগনিশন (মুখমণ্ডল চিহ্নিতকরণ) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনা দাহুয়া টেকনোলজি মস্কোকে সহায়তা করছে। রুশ জনগণের ওপর নজরদারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে চীনা হাইকেভিশন ক্যামেরা। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সংশ্লিষ্ট উপকরণও রাশিয়া আনছে চীন থেকে। সব মিলিয়ে রাশিয়ায় চীনের ব্যবসা বেশ রমরমা। আবার পারমাণবিক অস্ত্র বাদে রাশিয়ার বাকি অস্ত্রভান্ডারও বেইজিংয়ের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এমনকি ‘এস-৪০০’ নামের অত্যাধুনিক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থারও নাগাল পেয়ে গেছে চীনারা।

গত মাসেই চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে রাশিয়া। রুশদের ফাইভ-জি প্রযুক্তি দেবে হুয়াওয়ে। ছবি: রয়টার্স

এদিকে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কথাতেও সম্পর্কের হৃদ্যতা স্পষ্ট। গত মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়া সফর করেছেন। সেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, গত কয়েক বছরে রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে। আর জবাবে সি চিন পিং বলে দিয়েছেন, পুতিন তাঁর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, স্তালিন আর মাওয়ের বন্ধুত্বই যেন নতুন রূপে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন পিং-পুতিন।

কার্নেগি মস্কো সেন্টার বলছে, ওপরের চিত্র বিবেচনায় নিলে বলাই যায় যে চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে রাশিয়া। আর এই মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণেই প্রয়োজনের সময়েও চীনের বিরোধিতা করা মস্কোর জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

শুধু রাশিয়া নয়, এবার রুশ প্রভাবাধীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও হাত বাড়িয়েছে চীন। কাজাখস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলোতে চীন ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কার্যকর করার জন্যই মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে দরকার চীনের। রুশ প্রভাব কাজে লাগিয়েই মধ্য এশিয়ায় অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করছে চীনা সরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো অনেকটার রাশিয়ার বাড়ির পেছনের উঠানের মতো। আবার সীমান্ত–সংলগ্ন ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় চীনেরও তাদের সমর্থন প্রয়োজন। তাই ঢালা হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউয়ান। আর মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পথেঘাটে চোখে পড়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘চায়না এইড’। অর্থাৎ, গত শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যা করত, সেই ভূমিকাই এবার নিয়েছে চীন।

ইউয়ান, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশকে হাতের মুঠোয় পুড়ে ফেলতে চাইছেন সি চিন পিং। ছবি: এএফপি

উইঘুর প্রশ্ন এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই চীন মধ্য এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, এসব দেশে অনানুষ্ঠানিক সামরিক মহড়াও চালাচ্ছে চীন, দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। ফলে মধ্য এশিয়ায় রুশ একাধিপত্য ক্ষয়ে যাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে একধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা। কিন্তু ইউয়ানের ফাঁদে আটকে পড়ে রাশিয়ার পক্ষে এর বিরুদ্ধাচরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দিন যত যাবে, এই অস্বস্তি যে আরও বাড়বে—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের রাফায়েলো পানতুচ্চি বলছেন, ‘চীন পুরো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মানসিকতা বদলে দিচ্ছে। আগে সবাই ছিল মস্কোমুখী, আর এখন সব রাস্তা যাচ্ছে বেইজিংয়ের দিকে।’

সুতরাং, একটি বিষয় স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে ছড়ি ঘোরানোর অবস্থানে আছে সি চিন পিংয়ের দেশ। কারণ চীনকে বেশি দরকার রাশিয়ার। ফুদান ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রাশান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজের প্রধান ফাং ইউজুনের মতে, রাশিয়ার সঙ্গে জোট বাঁধা ও শত্রুতা—দুটোই এড়িয়ে চলতে চাইছে চীন। দেশটি নিচ্ছে একধরনের নিরপেক্ষ ভূমিকা। রাশিয়া বেশি ঝুঁকলেও চীন থাকতে চাইছে নিরাপদ দূরত্বে। ফাং ইউজুন বলেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কটিই (চীনের জন্য) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্তালিন ও মাও যেসব ভুল করেছিলেন, সেগুলো আমরা করতে চাই না। কারণ চীনের ওপর রাশিয়া যতটা নির্ভরশীল, রাশিয়ার ওপর চীন ততটা নয়।’

চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ছড়ি ঘোরানোর অবস্থানে নেই ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ। কারণ চীনকে বেশি দরকার রাশিয়ার। ছবি: রয়টার্স

অবশ্য এখনো সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এটি মূলত সম্ভব হচ্ছে পুতিনের কারণে। কারণ রাশিয়ার মতো সামরিক ক্ষমতাশালী দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও যুদ্ধ করতে জানে। কিন্তু যদি কোনো কারণে পুতিন দৃশ্যপট থেকে সরে যান, তখন কী হবে? রাশিয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পুতিনের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার কথা। যদিও পুতিন বা সি চিন পিংয়ের মতো নেতাদের জন্য আইন বদলানো কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু হুট করে পতন হলে বেশ বিপদেই পড়তে পারে রাশিয়া। পুতিনের অন্যতম বিরোধী রাজনীতিক আলেক্সেই নাভালনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পুতিন যা করছেন, তার জন্য রাশিয়ার পরবর্তী নেতাকে চীনের কাছে জিম্মি হতে হবে। ভবিষ্যতে আর নিজেদের লাভের কথা ভেবে চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবেন না কোনো রুশ রাষ্ট্রপ্রধান।’

তবে কি বেইজিংয়ের কারখানায় বানানো কলের পুতুলে পরিণত হবে পুতিনের রাশিয়া? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।