সেনাবাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েও বিক্ষোভকারীদের থামাতে পারেনি শ্রীলঙ্কা সরকার। প্রেসিডেন্টের পদ থেকে গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবিতে অনড় বিক্ষোভকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। গোতাবায়াকে ক্ষমতা ছাড়তে চাপ দিচ্ছে বিরোধী দলগুলোও। এই পরিস্থিতিতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সতর্ক করে বলেছেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে নতুন সরকার গঠন না করা গেলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়বে। দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে পদত্যাগ করবেন তিনি।
অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কার হাতে বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুত আছে, তা দিয়ে সপ্তাহখানেকের বেশি আমদানিপ্রক্রিয়া চালানো সম্ভব হবে না। গভর্নর নন্দলাল বিরাসিংহে গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছাড়া সে আলোচনা এগোবে না।
এই পরিস্থিতিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার দাবি জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দল সমাজি জনা বালাভেগায়া (এসজেবি)। দলটির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা গতকাল বলেছেন, শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে বের করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে তাঁরা রাজি আছেন। তবে এর জন্য চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথম শর্তই হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে।
এদিকে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ চলছে। সেখানে বিক্ষোভে অংশ নেন মোহনদাস অরবিন্দ। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না রাজাপক্ষে পরিবারের কেউ সরকারে থাকুক।’
তুমুল বিক্ষোভের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন গোতাবায়ার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে। প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাব ধরে রাখা মাহিন্দা জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে পালিয়ে একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই দিন থেকে চলমান বিক্ষোভ সহিংসতায় দেশটিতে অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন। সোমবার রাতভর রাজাপক্ষ সরকারের মন্ত্রী–এমপি ও তাদের দলীয় নেতাদের বাড়ি–গাড়িতে হামলা–অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে কারফিউ জারির পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে এরপর মঙ্গলবার রাতেও সড়কে বিক্ষোভ করেছেন কলম্বোর অনেক তরুণ। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবিতে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে গতকাল পুলিশকেও জানমাল রক্ষায় গুলি চালানোর ক্ষমতা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া গতকাল জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে চলতি সপ্তাহের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই সরকারের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। তারা দেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। এ ছাড়া নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার যাতে নতুন কর্মসূচি নিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারে, সে জন্য সংবিধান সংশোধন করে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। তবে তাঁর এই ঘোষণার পরেও বিক্ষোভকারীরা তাঁদের অবস্থান অনড় রয়েছেন।
সেনাবাহিনীর পর গতকাল পুলিশকেও গুলি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, এই গুলি চালানোর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব জেনারেল জি ডি এইচ কমল গুনারত্নে। তিনি বলেন, ‘গুলি চালানোর বিষয়টি হলো একেবারে শেষ ধাপের পদক্ষেপ। আমরা আমাদের মানুষের ওপর গুলি চালাতে চাই না।’
কমল গুনারত্নে বলেন, ‘পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছে। আশা করি, আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) কারফিউ তুলে নেওয়া যাবে।’
তবে বিক্ষোভকারীদের ওপর চাপ বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যম ডেইলি মিরর–এর খবরে বলা হয়েছে, বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের খুঁজছে পুলিশ। এ ছাড়া পুলিশ ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৫৯টি গ্রুপ খুঁজে পেয়েছে, যেগুলো ৯ মে সহিংসতা উসকে দিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ঘটনার তদন্ত চলছে।
তবে এভাবে বিক্ষোভ দমন করা যাবে না বলে মনে করেন বিক্ষোভকারীরা। এ প্রসঙ্গে আমালিনি নামে এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের রেকর্ড আছে বিক্ষোভ দমনে সামরিক বাহিনী ব্যবহারের। আমার ধারণা, এভাবে সাধারণ মানুষকে নিবৃত্ত করা যাবে না।’
শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাসচিব কমল গুনারত্নে গতকাল বলেছেন, মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী যেখানে যেতে চান, সেখানে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রিজের সামনে বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে উঠলে নিরাপত্তার জন্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এখন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ত্রিঙ্কোমালির নৌঘাঁটিতে রয়েছেন। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে তাঁকে তাঁর পছন্দমতো জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হবে।