ছয় বছর আগে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়াতে আশ্রয় নেন কিম ইয়ুন কিউং (ছদ্মনাম)। উত্তর কোরিয়ায় থাকাকালে সেখানকার একটি বাজারে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত তাঁর। সেখানে ঘরোয়া জিনিস বিক্রির কাজ করতেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় তৈরি নাটকগুলো উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ হওয়ায় সেখানে অবৈধভাবেই এসব নাটকের সিডি বিক্রি করতেন এ নারী। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর ঘরের কাজ আর মেয়ের দেখাশোনা করে সময় কেটে যেত তাঁর।
কিম ইয়ুন বলেন, তাঁর স্বামী রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন একটি কারখানায় দিনে কয়েক ঘণ্টা মাত্র কাজ করতেন। দিনের বাকি সময় জুয়া খেলে ও মদ পান করে সময় কাটত তাঁর। দুজনের মধ্যে খুব কমই দেখা হতো। কিম ইয়ুন বলেন, ‘ও যদি আমাকে ঘরের কাজে সাহায্য করত, তাহলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু আমরা একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জীবন যাপন করতাম। সত্যি কথা বলতে, একমাত্র নিজেদের আর্থিক অবস্থা নিয়েই আমাদের মধ্যে কথা হতো।’
কিম ইয়ুনের দাম্পত্যজীবনের গল্পটি উত্তর কোরিয়ায় খুব পরিচিত ঘটনা। গত দুই দশকে যাঁরা দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, উত্তর কোরিয়ার অন্য নারীরাও একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার।
১৯৯০–এর দশকে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও জনবিতরণব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর নারীশ্রমিক নিয়োগের শর্ত আরও শিথিল করে উত্তর কোরিয়া। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে বেশির ভাগ পুরুষকে বাধ্য করে সরকার। এ ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় স্বাধীন। বাজারে পণ্য বেচার কাজে নিয়োজিত হতে পারে তাঁরা। পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য হলেও তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বাধ্য হন। এভাবে অবশ্য উত্তর কোরিয়ার নারীদের কিছুটা অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ায় অনেক পরিবারেরই মূল উপার্জনকারী নারী। ২০২০ সালে ডেটাবেইস সেন্টার ফর নর্থ কোরিয়ান হিউম্যান রাইটস (এনকেডিবি) নামে সিউলভিত্তিক বেসরকারি একটি সংস্থা (এনজিও) জরিপ চালিয়েছিল। চীন সীমান্ত–সংলগ্ন উত্তর কোরীয় শহর হাইস্যান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আশ্রয় নেওয়া ৬০ শরণার্থীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, দেশে থাকতে বিবাহিতজীবন কেমন কাটত, তা নিয়ে। জরিপে অংশ নেওয়া শরণার্থীর ৪৭ শতাংশ বলেছেন, স্ত্রীরা পরিবারের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করেন। ৩৭ শতাংশ বলেছেন, স্বামীরা খাওয়ার খরচ জোগান। আর ১৭ শতাংশ বলেছেন স্বামী-স্ত্রী সমভূমিকা পালনের কথা। এনকেডিবির হান্না সং অবশ্য বলেছেন, হাইস্যান গোটা উত্তর কোরিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে দেশটির অন্যান্য অংশের শরণার্থীরা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে একই রকমের পরিস্থিতির কথাই জানা গেছে।
হান্না সং বলেন, উত্তর কোরিয়ায় নারীরা বাড়তি উপার্জন করলেও তাঁদের বাড়ির কাজের ধরনে এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। পারিবারিক জীবন সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যানধারণা একই রকম আছে।
এনকেডিবির জরিপে দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ উভয়ই সন্তান লালন-পালন ও ঘরের কাজকে নারীর কাজ বলে মনে করে। জিওং জিন নামের এক নারী এনকেডিবিকে বলেন, ‘অবশ্যই শিশুদের দেখাশোনার কাজটি নারীদের করা উচিত। কারণ, পুরুষের তুলনায় নারীরা কাজটি ভালোভাবে করতে পারে। আমার স্বামী সব সময় সন্তানের দেখাশোনা করছে, এমন দৃশ্য স্বাভাবিক মনে হয় না।’
জিন স্বীকার করেছেন, অনেক নারীই ঘরে-বাইরে দুই ধরনের কাজ করতে গিয়ে চাপের মধ্যে পড়েন। তবে তিনি মনে করেন, মূল ত্রুটির জায়গাটি রাষ্ট্র ব্যবস্থারই। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাতেই পুরুষেরা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়।
মানুষ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দোষারোপ করলেও প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যকার ব্যবধান থেকেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। পরিবারে স্বামীদের অবদান যেমনই থাকুক না কেন, তাঁরা চান স্ত্রীরা তাঁদের শ্রদ্ধা করবেন।
উত্তর কোরিয়ায় অকেজো স্বামীদের নিয়ে অপমানসূচক কয়েকটি শব্দ হলো হায়েবারাজি (সূর্যমুখী ফুল, যে স্বামী আয়েশ করে বসে স্ত্রীর বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় থাকেন), নেতজংদং (দিবা বাতি, সূর্যের আলোতে একটি বাতির যেমন কাজ নেই তেমন), কিংবা বুল পাইঅন (ঝামেলা, স্বামীদের নিয়ে তৈরি একটি নাটকের নাম)।
উত্তর কোরিয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নারীদের সঙ্গে প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা পুরুষদের বিয়েকে সবচেয়ে সফল বলে বলে মনে করা হয়। জিওং বলেন, এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে এবং তিনি সুখী। তবে চোরাচালানকারী হিসেবে তিনি ও তাঁর মা যে আয় করেছেন সেগুলো দিয়েই বেশির ভাগ সময় তাঁদের খরচ মেটাতে হয়। জিওং বলেন, ‘আমার স্বামী আয় কম করলেও তাঁর অনেক ক্ষমতা।’
উত্তর কোরিয়ার পুরুষেরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে বছরের পর বছর কম বেতনে চাকরি করলেও উচ্চ পদে আসীন হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। উচ্চ পদে পদোন্নতি হওয়ার পর তাঁদের বেতন বাড়ার পাশাপাশি পাচারকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আবার পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করলে পুরস্কার হিসেবে বোনাস পান তাঁরা। স্ত্রীদের অবৈধ ব্যবসাকেও সুরক্ষা দিতে পারেন এসব কর্মকর্তা।
উত্তর কোরিয়া সরকার নারীদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য আরও বেশি উদ্যোগ নেবে কিংবা পুরুষদের জন্য ভালো চাকরির সুযোগ দেবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন যুদ্ধবিমানের নারী পাইলট ও প্রকৌশলীদের নিয়ে সাময়িক গুণগান গাইলেও সম্প্রতি তাঁর অবস্থানের বদল হতে দেখা গেছে। পারিবারিক জীবন নিয়ে চিরাচরিত ধারণার ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি। উন নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন স্বামীদের জন্য সুন্দর করে সেজে থাকেন এবং সন্তানদের দেখাশোনা করেন। উত্তর কোরিয়ার নিপীড়িত বিবাহিত নারীদের জন্য কিমের অবস্থানও দিবা বাতির মতোই অকেজো। (ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)