উত্তর কোরিয়ায় আদা, চা আর উইলো পাতার পানিতে করোনার চিকিৎসা

চিকিৎসা উপকরণ বিতরণে কাজ করছেন সেনাসদস্যরা
ছবি: রয়টার্স

উত্তর কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। কিন্তু কোনো মানুষ করোনার টিকা পাননি। সে দেশে নেই ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ওষুধও। আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রস্তাবও নাকচ করে আসছে পিয়ংইয়ং। এমন অবস্থায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া দেশের মানুষকে গতানুগতিক কিছু স্বাস্থ্যবটিকা দিচ্ছে, যেগুলো করোনা প্রতিরোধে খুব একটা কার্যকর নয়।

রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে কিছু প্রচলিত চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। মূলত জ্বর সারাতে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই এ ক্ষেত্রে ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।

গরম পানীয়

যাঁরা গুরুতর অসুস্থ নন, তাঁদের জন্য ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র রোদং সিমনান সংবাদপত্রে করোনার চিকিৎসায় কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে—আদা কিংবা হানিসাকল চা এবং উইলো পাতা মেশানো পানি। গরম পানীয় গলাব্যথা ও কাশির মতো কিছু কোভিড উপসর্গ সারাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে পানিশূন্যতাও ঠেকানো যায়। আদা ও উইলো পাতা শরীরের প্রদাহ বন্ধে কাজ করে এবং ব্যথা কমায়। তবে এগুলোর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা যায় না।

লবণপানি

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি এক দম্পতির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ওই দম্পতি সকালে ও রাতে লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অ্যান্টিসেপটিক সল্যুশন তৈরি করতে পিয়ংইংয়ে হাজারো টন লবণ পাঠানো হয়েছে।’

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করা ও নাক ধোয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ ঠান্ডার জন্য দায়ী ভাইরাস মোকাবিলা করা যায়।

তবে এর মধ্য দিয়ে করোনার কার্যকর চিকিৎসা হয় না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরীক্ষাগারে মাউথওয়াশ ব্যবহার করে ভাইরাসকে মেরে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। তবে মানবশরীরে এটি তেমন কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি।

মূলত করোনাভাইরাস মানবশরীরে ঢুকে মানুষকে আক্রান্ত করে। গরগরার মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসের শুধু একটি প্রবেশপথকেই ঠেকানো যায়। একবার এই ভাইরাস মানবদেহে ঢুকলে, তা বিভিন্ন অঙ্গের গভীরে চলে যেতে থাকে। তাতে গড়গড়া আর কোনো কাজে আসে না।

পিয়ংইয়ংয়ের রাস্তায় মাস্ক পরে চলাফেরা করছেন সাধারণ মানুষ

ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, করোনার চিকিৎসায় যেন ইবুপ্রফেনের মতো ব্যথানাশক ও অ্যামোক্সাসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।

ইবুপ্রফেন (এবং প্যারাসিটামল) শরীরের তাপমাত্রা কমায় এবং মাথাব্যথা ও গলাব্যথার মতো উপসর্গগুলো কমাতে পারে। তবে এসব ওষুধ ভাইরাসকে ধ্বংস কিংবা প্রতিরোধ করতে পারে না।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকানো যায়, ভাইরাস নয়। বরং অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক কোভিডসহ কিছু ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর কার্যকারিতা দেখা যায়নি।

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ অ্যাজিথ্রোমাইসিন নিয়ে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডের উপসর্গ মোকাবিলা, হাসপাতালে ভর্তি বা মৃত্যুরোধে এর ভূমিকা নগণ্য কিংবা একেবারেই নেই।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা

গ্রামপর্যায়ে মৌলিক সেবা থেকে শুরু করে শহরের সরকারি হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে উত্তর কোরিয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং খরার মতো বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দেশটির অর্থনীতি সংকটে পড়েছে।

সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া এবং কঠোর লকডাউনের কারণেও দেশটির অর্থনীতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে পিয়ংইয়ংয়ের বাইরের এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

গত বছর জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কিছু ওষুধ কোম্পানি, টিকা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন কেন্দ্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারেনি। স্থানীয় চাহিদাও পূরণ করতে পারেনি তারা।

দেশ ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাওয়া অনেক উত্তর কোরীয় নাগরিক বলেন, তাঁদের ওষুধ ও চিকিৎসাসেবার জন্য অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল। চিকিৎসা ও ওষুধ ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে।

তবে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বলেছে, দেশে এখন ওষুধের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তা

২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। গত বছর চীনের তৈরি ৩০ লাখ ডোজ করোনার টিকা ফিরিয়ে দেয় দেশটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনার টিকা সরবরাহের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে তারা। দক্ষিণ কোরিয়া বলেছে, তারা টিকা, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসাকর্মী পাঠানোর প্রস্তাব দিলেও উত্তর কোরিয়া কোনো সাড়া দেয়নি।

সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, চীনের শেনইয়াং থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম নিতে তিনটি বিমান পাঠিয়েছে উত্তর কোরিয়া।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, মহামারি প্রতিরোধে কোনো সরঞ্জাম নিচ্ছে না উত্তর কোরিয়া। তবে করোনার নিয়ন্ত্রণে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত তারা।