একদিকে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তার কিছু দূরেই ব্যাগে মোড়ানো সারি সারি লাশ। আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তরের জন্য রাখা হয়েছে লাশগুলো। দুদিন পেরিয়ে যাওয়ায় লাশগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়ানো শুরু হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পালু শহরে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামিতে মৃত ব্যক্তিদের লাশ থেকে রোগ–জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কায় গণকবর খোঁড়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার।
ধ্বংসস্তূপে অনেকের আটকে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ধসে পড়া হোটেল ও শপিং মলগুলোয় উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ভারী যন্ত্রপাতির জন্য অপেক্ষা করছেন উদ্ধারকর্মীরা।
গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের পালু শহরে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের পর সুনামির ফলে সৃষ্ট প্রায় ২০ ফুট উঁচু ঢেউ পালু শহরকে ভাসিয়ে দেয়। মৃত মানুষের সংখ্যা ৮৩২-এ পৌঁছেছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিধসে শহরের প্রধান সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। লোকজন খোলা স্থানে অবস্থান করছে।
আজ সোমবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, পালু শহরের মামবোরো হেলথ ক্লিনিকের বাইরে এক কোনায় স্ট্রেচারে পাঁচ বছরের একটি মেয়েশিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার পা ভাঙা। উদ্ধারকর্মীরা তাকে একাই পায়। ক্লিনিকের চিকিৎসক সাসোনো জানান, শিশুটির পরিবার কোথায়, তা তাঁরা জানতে পারেননি। শিশুটি কোনো কিছু মনে করতে পারছে না। এদিকে তাঁর ক্লিনিকে বিদ্যুৎ নেই এবং চিকিৎসার সরঞ্জামও নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।
মেয়েটির থেকে কয়েক মিটার দূরেই ব্যাগে মোড়ানো লাশের সারি। সেগুলো থেকে বাতাসে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।
ডা. সাসোনো বলেন, লাশ থেকে রোগ–জীবাণু ছড়ানো ঠেকাতে গণকবরে লাশগুলোকে দাফন করা হবে। তিনি বলেন, ‘লাশ থেকে গন্ধ ছড়ানো শুরু করেছে। লাশগুলো স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’
ইন্দোনেশিয়ার দুর্যোগবিষয়ক সংস্থা গণকবরের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। গতকাল রোববার রাতে একটি গণকবর খোঁড়া হয়েছে। ওই কবরে কমপক্ষে ৩০০ মরদেহ সমাহিত করা হবে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো দুর্যোগ এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি দিন-রাতজুড়ে উদ্ধারকাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে ধ্বংসস্তূপে জীবিত লোকজন থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গত দুদিন হাত দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়েও উদ্ধারকর্মীরা উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে হোটেল ও শপিং মলগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে এভাবে উদ্ধারকাজে নিরাপদ বোধ করছেন না তাঁরা। এ জন্য ভারী যন্ত্রপাতির জন্য অপেক্ষা করছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ধসে পড়া শপিং মল থেকে মোবাইল ফোনের সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানের রোয়া রোয়া হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষের চিৎকার শোনা গেছে।
থালিব বাওয়ানো নামের একটি উদ্ধারকর্মী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, হোটেলটির ধ্বংসস্তূপ থেকে তিনজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ৫০ জনেরও বেশি সেখানে আটকে পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি জায়গায় শিশুসহ কয়েকজনের আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে পড়া এই মানুষগুলোকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে আমরা সাহস দিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাদের খাবার ও পানি দিয়েছি। কিন্তু তারা সেগুলো চাইছে না, তারা বেরিয়ে আসতে চাইছে। তারা ভয়ে চিৎকার করেই চলেছে।’
যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্ধারকাজ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ভূমিকম্পে যাদের বাড়ি ধসে পড়েনি, তারাও অন্যদের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। আবার ভূমিকম্পের ভয়ে তারা বাড়ি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাইরে তাঁবু গেড়ে বা খোলা স্থানেই আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। খোলা জায়গায় একটি সামরিক হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। এই ঘটনায় তাৎক্ষণিক সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে তা তুলে নেওয়া হয়। এ কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া সংস্থা।
গত মাসে ইন্দোনেশিয়ার লমবক দ্বীপে সিরিজ ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে ৫ আগস্টের ভূমিকম্পে দেশটিতে ৪৬০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটিতে ২০০৪ সালে ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ সুনামি আঘাত হানে। এতে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে।