এমনই এক জানুয়ারিতে তিউনিসিয়ায় বইতে শুরু করে আরব বসন্তের বাতাস। যদিও শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। ওই দিন নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে আরব বসন্তের আবহ তৈরি করেছিলেন তিউনিসিয়ার সবজিবিক্রেতা বাওয়াজিজি। তাঁর আত্মাহুতি ছিল ঘুষ, দুর্নীতি আর বেকারত্বের প্রতিবাদে। পরে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়ায় দোলা দিয়ে সেই বাতাস মিলিয়েও যায়। এসবের পেরিয়ে গেছে আটটি বছরও। এত দিন পর এসে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল, তা হলো—এই আরব বসন্ত তিউনিসিয়ার তরুণদের কী দিল?
এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিউনিসিয়ার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আরব বসন্তের ফল নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সবাই মানছেন, ওই বিপ্লবের কারণে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন একনায়ক জয়নাল আবেদিন বেন আলী। নতুন দিনের স্বপ্ন বুনেছিলেন ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণেরা। এত দিন পর এসে বেশির ভাগই মনে করেন, তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মানুষ হিসেবে তাঁদের মর্যাদা যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও আসেনি।
রাজধানী তিউনিস থেকে পশ্চিমে অবস্থিত কর্মজীবী মানুষের বসতি দুয়ার হিচার। সেখানকার বাসিন্দা সোফিনি জেবেলি। বেকার এই কম্পিউটার কারিগর বলেন, ‘আরব বসন্তের পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, তবে এখনো মর্যাদা পাইনি।’ আরব বসন্তে অংশগ্রহণের জন্য অনুশোচনা বোধ করেন না তিনি। বরং বেন আলীর মতো শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারায় স্বস্তিবোধ করেন। ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক বলেন, এ বছর প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। পরিবর্তন আনতে হবে। প্রচলিত ব্যবস্থায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে কিছুই বদলাবে না।
জেবেলির কথার বেশির ভাগের সঙ্গে একমত পোষণ করলেন এনজিও ইন্টারন্যাশনাল অ্যালার্টের সমাজবিজ্ঞানী ওলফা লামলুম। তবে দেশটিতে আরব বসন্তের সেই বিপ্লব পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, এটা মানতে নারাজ তিনি। সেই বিপ্লবের মূল কথা ছিল—‘কাজ, মর্যাদা আর স্বাধীনতা’। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাকি দুটি এখনো অধরা রয়ে গেছে বলে মন্তব্য তাঁর।
দেশটির গণতান্ত্রিক পালাবদলের প্রশংসা হলেও সম্পদ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এখনো মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে। তিউনিসিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশ। বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশের বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক হওয়াদের জন্য চাকরির বাজার খুবই খারাপ। তবে আশার কথা হলো, তরুণেরা এখনো হাল ছাড়েননি। গত বছরের মে মাসে দেশটির মিউনিসিপ্যালের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ৫৭ হাজারের বেশি প্রার্থী অংশ নেন। তাঁদের প্রায় অর্ধেক নারী ও তরুণ প্রজন্ম।
ওলফা লামলুম নির্বাচনে নারী ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মন্তব্য করেন। তবে তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য কিছু করা হয়নি। সামাজিকভাবে তাদের অবস্থা আসলেই অনেক খারাপ। এই সমাজবিজ্ঞানীর মতে, বিপ্লবের একটি বড় অর্জন হলো—বিতর্কের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। যেকোনো বিষয় নিয়ে মানুষ এখন প্রশ্ন তুলতে পারে। যদিও রাজনীতিবিদেরা এটাকে ভালো কোনো কাজে লাগিয়ে জনগণের সমস্যার কোনো ধরনের সমাধান করেন না।
নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করার ঘটনা এখনো অব্যাহত আছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। তখন ৩৫ বছরের কম বয়সী বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সরকারের এমন আচরণকে অমানবিক বলে সমালোচনা করেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা। এটা নিয়ে সে সময়ের বিপ্লবীদের যেমন আক্ষেপ আছে, আক্ষেপ আছে এ সময়কার তরুণদেরও।
হামজা ধিফালি নামে উচ্চমাধ্যমিকের এক ছাত্র বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি নাগরিক হওয়ার জন্য বিপ্লব করেছিলাম। তবে আমরা শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছি। আগে আমি মুক্তভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারতাম না, এখন পারি। এটা ভালো। তবে কেউ আমাদের কথা শোনে না।’
আরব বসন্ত আন্দোলনের কর্মী ও বর্তমানে ৩১ বছরের যুবক ইসাম ইলাহি বলেন, নানা প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ তরুণদের ঋণ দেওয়ার কথা বলেছিল। তবে সেটা কোনোভাবেই সহায়ক না। তাঁর ভাষায়, ‘ছোট হার্ডওয়্যারের দোকান দেওয়ার জন্য আমি ২ হাজার ৪০০ ডলার ঋণ নিয়েছিলাম। সুদের হার ২১ শতাংশ। এত চড়া সুদের ভার আমি সইতে পারছি না। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘আমরা এমন নৌকায় চড়েছি, যার নাবিক দেখছেন নৌকাটি ডুবে যাচ্ছে।’ তিনি নিজে এখন এই নৌকা থেকে নেমে যেতে চান। চান, দেশের বাইরে কোথাও নতুনভাবে জীবন শুরু করতে।
১৭ বছর বয়সী জেইনাব রানেন মনে করেন, সফলভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে পারলে তিনি মর্যাদা অর্জন করতে পারবেন। শিক্ষার মাধ্যমেই কেবল এটা অর্জন করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘এখানে যে সম্মান ও মর্যাদা আমি পাইনি, সেটা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে আমি বিদেশ যেতে চাই।’ তাঁর এই কথা থেকেই স্পষ্ট, মানুষ হিসেবে সম্মান আর মর্যাদা পাওয়ার যে স্বপ্ন তিউনিসিয়ার তরুণেরা দেখেন, তা এখনো অধরা।